সংবাদদাতা, কাঁথি: একটা সময়ে গ্রামের মানুষের মনোরঞ্জনের অন্যতম মাধ্যম ছিল পুতুলনাচ। পুজোপার্বণে অন্যান্য অনুষ্ঠানের পাশাপাশি পুতুলনাচের আসর বসত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিনোদনের হাজারো উপকরণের ভিড়ে পুতুলনাচের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেছে। আগের মতো বায়না হয় না। শিল্পীরা যথেষ্ট সাম্মানিকও পান না। ফলে অনেকেই পেশা ছেড়েছেন, নতুন প্রজন্মও আর এই শিল্পে আসতে আগ্রহী নয়। ফলে পুতুলনাচ শিল্প প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছে। কিন্তু নানা সমস্যা সত্ত্বেও কাঁথি-৩ ব্লকের ভাজাচাউলি গ্রাম পঞ্চায়েতের কুমুরিয়া-খানকাখুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা দুই ভাই প্রদীপ গিরি ও পীযূষ গিরি পুতুলনাচের ঐতিহ্যকে আজও টিকিয়ে রেখেছেন। তাঁদের দলের নাম যথাক্রমে ‘অগ্রদূত পুতুল থিয়েটার’ ও ‘রয়্যালস্টার পুতুল থিয়েটার’। প্রদীপ ও পীযুষের বাবা কার্তিক গিরির ছিল ‘অগ্রগামী পুতুল থিয়েটার’ নামে পুতুলনাচের দল। বছরদুয়েক আগে কার্তিকবাবু মারা যাওয়ার পর তাঁর দুই ছেলে শিল্পটিকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন। দুই ভাইয়ের গোটা পরিবারই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া এলাকার আরও কয়েকজন ওই দলে রয়েছেন। এক একটি দলে ১৪-১৫ জন কলাকুশলী থাকেন। কেউ কণ্ঠদান করেন, কেউ পুতুল নাচান, কেউ আবহসঙ্গীত পরিবেশন করেন আবার কেউ আলোক সম্পাত করেন। দু’রকমের পুতুলনাচ রয়েছে— রড পাপেট ও স্প্রিং পাপেট। রড পাপেটেরই চল বেশি। দুই ভাই পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক পালা করেন। ‘হনুমানের লঙ্কাকাণ্ড’, ‘আলিফ লায়লা’, ‘বাবা-আসামী ছেলে পুলিস’, ‘অসুরনাশিনী দুর্গা’, ‘কৃষ্ণের জন্মলীলা’ সহ আরও অনেক পালা রয়েছে। পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে এইড, পালস পোলিও প্রভৃতি রোগ নিয়ে সচেতনতা প্রচারও চালান তাঁরা।
কার্তিকবাবু যখন বেঁচেছিলেন, তখন তিনি ওড়িশা, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, রাজস্থান প্রভৃতি জায়গায় শো করতে যেতেন। সম্প্রতি দেশপ্রাণ ব্লকের আলাদারপুট এলাকায় পুজো উপলক্ষ্যে পীযূষ তাঁর টিম নিয়ে শো করতে এসেছিলেন। পীযূষ সহ স্বপনকুমার গিরি, পদ্মলোচন পড়্যা, মতিলাল পড়্যা, শম্ভুরাম পড়্যাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁরা বলছেন, বায়না কমে গিয়েছে। তবুও এখনও কিছু কিছু জায়গায় পুজোপার্বণ উপলক্ষ্যে পুতুলনাচের আসর বসবেই। সম্প্রতি দুর্গাপুজোয় আমাদের বেশ কয়েকটা শো হয়েছে। আর সরকারি কর্মসূচিও থাকে। এভাবেই আমাদের শিল্প টিঁকে রয়েছে। আমরা দুই মেদিনীপুর সহ বিভিন্ন জেলায় শো করতে যাই। এক একটি শো করতে অনেক টাকা খরচ হয়। অনেকে পুতুলনাচের নাম শুনলে নাক সিঁটকোন। তবে শো দেখে এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন। স্বীকার করেন, অন্যান্য চলতি অনুষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা পুতুলনাচ। পীযূষ ও প্রদীপ বলছিলেন, পুতুলনাচের জন্য প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রীর দাম বেড়েছে। পাশাপাশি কলাকুশলীদের পারিশ্রমিক সহ অন্যান্য খরচ তো রয়েছেই। সেই অনুপাতে উদ্যোক্তারা টাকা দিতে চান না। নানা সমস্যা সত্ত্বেও ঐতিহ্যের টান আর পেটের তাগিদে আমরা শিল্পটাকে ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা শিল্পী হিসেবে সরকারি ভাতা পাই বটে। কিন্তু দলের নামে অনুদান দিলে ভালো হতো। কারণ যত দিন যাচ্ছে, পুতুলনাচের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে। বাড়ছে খরচ। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বিকাশচন্দ্র বেজ বলেন, গিরি ভাইদের পুতুলনাচ শিল্প কাঁথির গর্ব। তাঁরা সরকারি ভাতা পান। তবে যে কোনও সমস্যায় আমরা তাঁদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত। -নিজস্ব চিত্র