কৃষ্ণনগরের তরুণী খুনের সব রহস্য কি লুকিয়ে তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট আর ফোন কলেই? মঙ্গলবার ঘটনার দিন রাত দশটা চব্বিশে তরুণীর ফেসবুকে ( আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়.... ) কে পোস্ট করল, সেই প্রশ্নের জবাব এখনও মেলেনি। ঠিক তেমনই স্পষ্ট হয়নি পাসওয়ার্ড আগে থেকে জেনে যাওয়ায় তরুণীকে খুনের পরে অভিযুক্ত রাহুলই ওই পোস্ট করেছে কি না, তাও। নিহত তরুণী অবিবাহিত বলে পরিবারের তরফে দাবি করা হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় তার অন্য একটি অ্যাকাউন্টে লেখা ‘ম্যারেড।’ যা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।তরুণীর প্রেমিক ধৃত রাহুল বসু ওই দিন রাত দশটা বারো থেকে দশটা পনেরো পর্যন্ত ফোনে তরুণীর সঙ্গে কথা বলেছেন। সেই কল রেকর্ডের হদিশ পেয়েছে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। এসপি অফিসের কাছে পাড়ার পুজো প্যান্ডেলের যে রাস্তা থেকে বুধবার সকালে তরুণীর মৃতদেহ মিলেছিল, যেখান থেকে মিনিট তিনেক দূরত্বে কৃষ্ণনগরের কলেজ মাঠে রাহুলের মোবাইলের টাওয়ার লোকেশনও পায় পুলিশ।
যদিও অভিযুক্তের বাবার দাবি, মঙ্গলবার ছেলে অন্য এক বান্ধবীর সঙ্গে শান্তিপুর গিয়েছিল সিনেমা দেখতে। আর মায়ের দাবি, ছেলে রানাঘাটে গিয়েছিল। বাড়ি ফেরার পরে রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ কৃষ্ণনগরের ওই তরুণীর বাড়ি থেকে ফোন এলে এক বন্ধুকে নিয়ে ঘণ্টাখানেকের জন্য বাইরে গিয়েছিল। তরুণী, রাহুল ও রাহুলের বন্ধুর ফোনের কল লিস্ট, টাওয়ার লোকেশন খতিয়ে দেখছে পুলিশ। দেখা হচ্ছে শহরের ওইসব এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজও।
এ দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ধৃত রাহুল যেভাবে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেছে, তাতে অবাক পুলিশ কর্তারাও। মঙ্গলবার কোথায় ছিলেন? রাহুলের উত্তর, ‘আমি ছিলাম না স্যর। সেদিন রানাঘাট গিয়েছিলাম।’ ওইদিন রাতে কোথায় ছিলেন? উত্তর, ‘বাড়িতে ছিলাম।’ ওইদিন রাত দশটা পনেরোতে কৃষ্ণনগর কলেজ মাঠে কী করছিলেন?
আপনার মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন তো ওখানে পাওয়া গিয়েছে। উত্তর, ‘এক বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলাম। আর কেউ ছিল না। পুরোদিন দেখা হয়নি। ওর (তরুণী) সঙ্গে দেখা করে কথা বলার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখা হয়নি। শুধু ফোনে কথা হয়েছিল।’ তাহলে ঘটনা কী করে ঘটল? উত্তর, ‘জানি না সেটা।’ মেয়েটিকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন? উত্তর : ‘ডেকে পাঠাইনি । জাস্ট ফোনে কথা হয়েছিল।’ রাত দশটা বারো থেকে দশটা পনেরোর মধ্যে ঠিক কী কথা হয়েছিল? উত্তর : ‘তুই কোথায়? আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখিস না। এই কথা।’
ধার দেওয়া ৪০ হাজার টাকা কি ফেরত চেয়েছিলেন? উত্তর, ‘চেয়েছিলাম। দেয়নি।’ এ দিন রাহুলের মা চায়না বসুর দাবি করেন, ‘মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওই মেয়েটি তিন বার ফোন করেছিল। রাত ন’টার পরে মেয়েটির মা ফোন করেছিলেন। রাহুল বাড়িতে আছে কিনা জানতে চেয়েছিলেন। আমি তখন খাচ্ছিলাম। রাহুল শুয়েছিল। পরে রাহুল রিং ব্যাক করে। এক বন্ধুর সঙ্গে রাতে ঘণ্টাখানেক বেরিয়েছিল। কোথায় গিয়েছিল জানি না।’
চল্লিশ হাজার টাকা ধার দেওয়া নিয়ে নিহত ছাত্রীর মা বলেন, ‘এটা ওর বানানো গল্প। মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হচ্ছে।’ তরুণীর সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্টে লেখা নিয়ে তরুণীর মায়ের দাবি, ‘এ ধরনের পোস্ট মেয়ে নিজে দেবে না। আমার মেয়ে মোটেই আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে নয়।’ অন্যদিকে রাহুলের বাবা বলেন, ‘ছেলে বেঙ্গালুরুতে হোটেলে কাজ করে। মাস দেড়েক আগে এই মেয়েটি ছেলের সঙ্গে ওখানে চলে গিয়েছিল। দিন পনেরো ছিল সেখানে। তারপর ওর বাড়ির লোকজনের চাপে ফিরে আসে। তবে ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়নি।’
রাজ্য পুলিশের এডিজি (সাউথ বেঙ্গল) সুপ্রতিম সরকার বলেন, ‘জেলা পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে একটি সিট গঠন করা হয়েছে। সিআইডিও তদন্তের সাহায্য করছে।’
এ দিন ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয় একটি দেশলাই ও একটি খালি বোতল। সম্ভবত তাতে কেরোসিন তেল ছিল। ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্টরা ওই বোতল থেকে হাতের ছাপের নমুনা নিয়েছেন। পুড়িয়ে খুন, নাকি অন্য জায়গায় খুন করে এখানে এনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, স্পষ্ট হয়নি এখনও। পুলিশ সুপার অমরনাথ কে বলেন, ‘মৃতের পরিবারের দাবি আদালতে জানিয়েছিলাম। আদালত থেকে অনুমতি মেলায় ভিডিয়োগ্রাফি করে, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে কল্যাণীর হাসপাতাল মর্গে পোস্টমর্টেম হয়েছে। সব রিপোর্ট হাতে আসার পরে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে।