• আত্মহত্যা না খুন! তরুণীর ফোনের অডিয়ো খতিয়ে দেখছে কৃষ্ণনগর পুলিশ, যাচাই করা হবে কণ্ঠস্বরও
    আনন্দবাজার | ১৯ অক্টোবর ২০২৪
  • কৃষ্ণনগরের তরুণীকে কি খুন করা হয়েছিল? না কি আত্মহত্যা করেছেন তিনি? এখন সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছে পুলিশ। এই পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে এসেছে একটি অডিয়ো ক্লিপ, যা তরুণীর হোয়াটস্‌অ্যাপ স্টেটাসে পোস্ট করা হয়েছিল। সেখানে এক মহিলাকণ্ঠকে বলতে শোনা গিয়েছে যে, তাঁর মৃত্যুর জন্য তিনি নিজেই দায়ী। এই কণ্ঠস্বর তরুণীর কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তাদের তরফে জানানো হয়েছে, তরুণীর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলে তবেই নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে, তিনি খুন হয়েছেন না কি, আত্মহত্যা করেছেন।

    বুধবার কৃষ্ণনগরের এক মণ্ডপের কাছ থেকে উদ্ধার হয় অর্ধদগ্ধ অর্ধনগ্ন এক তরুণীর দেহ। তাঁর মা দাবি করেন, মেয়েকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। আঙুল তোলেন তরুণীর প্রেমিকের দিকে। তার পরেই যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। যুবকের বাবা-মা যদিও এই অভিযোগ মানেননি। এই ঘটনায় সিট গঠন করে তদন্তে নেমেছে রাজ্য পুলিশ। সেই তদন্তেই উঠে এসেছে একাধিক তথ্য। তদন্তকারীদের হাতে এসেছে একটি অডিয়ো। সেই অডিয়োটি মৃতার হোয়াটস‌্অ্যাপ অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা হয়েছিল। তাতে এক মহিলাকণ্ঠকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘আমার মৃত্যুর জন্য আমিই নিজে দায়ী। আমি কখনও কাউকে দোষী করিনি, করবও না। এই পরিস্থিতির জন্য আমার পরিবার, বন্ধু বা প্রেমিক, কেউ দায়ী নন। বন্ধু-বান্ধবেরাও এর মধ্যে নেই। পরিবারের কোনও ব্যক্তিও নেই। আমার হবু (স্বামী) বা তাঁর পরিবারও জড়িত নন।’’ এই অডিয়ো তদন্তকারীদের হাতে আসার পর প্রশ্ন উঠছে, তবে কি আত্মহত্যাই করেছেন তরুণী? কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার অমরনাথ কে জানিয়েছেন, তরুণীর হোয়াট্‌সঅ্যাপ স্টেটাসে যে অডিয়ো ক্লিপ মিলেছে, সেটি পরীক্ষা করে দেখা হবে। অডিয়ো ক্লিপে যে কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছে, তা ওই তরুণীরই কি না, তা-ও যাচাই করা হবে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলে তবেই মৃত্যুর কারণ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

    পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পেরেছে, ঘটনার রাতে একাধিক জনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তরুণী। অভিযুক্ত তরুণও ফোনে কথা বলেছিলেন। সেই সব ‘ফোন কল’ খতিয়ে দেখছে পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে একটি প্লাস্টিকের বোতল উদ্ধার করেছে ফরেন্সিক দল। তাতে কেরোসিন রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।

    এই পরিস্থিতিতে অভিযুক্তের সঙ্গে তরুণীর সম্পর্কও তদন্তকারীদের আতশকাচের তলায় রয়েছে। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, তরুণীকে ৪০ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলেন অভিযুক্ত। সেই টাকা ফেরত চেয়েছিলেন তিনি। সূত্রের খবর, টাকা ফেরানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন তরুণী। সেই টাকার জন্য তরুণীকে চাপ দেওয়া হচ্ছিল কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

    পরিবার সূত্রেই পুলিশ জেনেছে, তরুণী মিউজ়িক ভিডিয়ো তৈরি করে ইউটিউবে পোস্ট করতেন। অভিযুক্ত তরুণ বাইক চালানোর ‘ভ্লগ’ তৈরি করতেন। দু’জনেই সমাজমাধ্যমে ‘ডিজিটাল ক্রিয়েটর’দের একটি গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। দু’জনের পরিচিতদের একটি অংশ বলছেন, প্রায় এক বছর আগে ওই গোষ্ঠীর মাধ্যমেই তরুণীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল অভিযুক্তের। তরুণীর মা যদিও দাবি করেছেন, চার মাস আগে দু’জনের পরিচয় হয়েছে। সমাজমাধ্যমে অভিযুক্তকে ট্যাগ করে একাধিক পোস্ট করতেও দেখা গিয়েছে তরুণীকে। অভিযুক্তের বাবা দাবি করেছেন, মাস কয়েক আগে তাঁর ছেলের কাছে বেঙ্গালুরু গিয়েছিলেন তরুণী। দিন পনেরো থেকে নিজের পরিবারের চাপে ফিরে এসেছিলেন। সে সময় তরুণী সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। সেই পোস্টে অভিযুক্তের সঙ্গে তাঁর ‘বিয়ে করার’ খবর প্রকাশ করেছিলেন তিনি। তরুণীর মায়ের দাবি, ওই পোস্টের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। অভিযুক্তের বাবার দাবি, তরুণীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে হয়নি। এই বিষয়গুলিই এখন খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তারা অপেক্ষায় রয়েছে ময়নাতদন্তের রিপোর্টের। তাদের তরফে জানানো হয়েছে, রিপোর্ট এলেই মৃত্যুর কারণ নিয়ে নিশ্চিত করে বলা যাবে।

    প্রেমিক বেঙ্গালুরুতে কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এক বার সেখানেও চলে গিয়েছিলেন কৃষ্ণনগরের ওই তরুণী। মাসখানেক সেখানে ছিলেনও প্রেমিকের সঙ্গে। পরে অবশ্য পারিবারিক চাপেই তাঁকে ফিরে আসতে হয় কৃষ্ণনগরের বাড়িতে। এমনই দাবি করেছেন তরুণী এবং অভিযুক্ত— দু’জনের পরিবারই। তরুণীর মায়ের দাবি, অভিযুক্তের সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক প্রথমে মেনে নিতে পারেননি তাঁরা। পরে মেয়ের কথা ভেবেই মেনে নিয়েছিলেন। তরুণীর মায়ের আরও দাবি, ওই যুবক জানিয়েছিলেন পাঁচ বছরের আগে বিয়ে করতে পারবেন না। অভিযুক্তের মা সম্পর্কের কথা মেনে নিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, তরুণীর সঙ্গে তাঁর ছেলের বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল। তবে তাঁদের মধ্যে কোনও অশান্তি ছিল কি না, তিনি জানেন না।

    অভিযুক্তের সঙ্গে সত্যিই কি বিয়ে হয়েছিল কৃষ্ণনগরের ‘নির্যাতিতা’ তরুণীর? গত জুন মাসে সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়ে ‘বিয়ে হয়ে গিয়েছে’ বলেই দাবি করেছিলেন তিনি। ২৫ জুন পোস্ট করে তরুণী জানিয়েছিলেন, ২৪ জুন তাঁদের বিয়ে হয়েছে। যদিও তরুণীর মা শুক্রবার দাবি করেছেন, ওই পোস্টের বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না। অভিযুক্ত যুবকের বাবাও ‘বিয়ে হয়েছিল’ বলে মানতে চাননি। তাঁর দাবি, মাস কয়েক আগে বেঙ্গালুরুতে তাঁর ছেলের কাছে চলে গিয়েছিলেন তরুণী। দিন পনেরো সেখানে ছিলেন। মনে করা হচ্ছে, সেই সময়েই ফেসবুকে ওই পোস্ট দিয়েছিলেন তরুণী। যদিও অভিযুক্তের বাবা স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘ও (তরুণী) বাড়ির লোকজনের চাপে ফিরে আসে। আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়নি।’’

    তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, কৃষ্ণনগরের ওই তরুণীকে ৪০ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলেন তাঁর প্রেমিক। সেই টাকা ফেরত চেয়ে চাপ দিচ্ছিলেন তিনি বলে মনে করছেন তদন্তকারীদের একাংশ। সূত্রের খবর, অভিযুক্ত যুবকের বাইকের নেশা রয়েছে। বাইক চালাতে খুব ভালবাসেন তিনি। বাইক কেনার পরিকল্পনাও করেছিলেন। সেই কারণে ধার দেওয়া টাকা ফেরত চাইছিলেন প্রেমিকার কাছ থেকে। টাকা ফেরতের আশ্বাসও তিনি পেয়েছিলেন বলে খবর। কিন্তু তার আগেই তরুণীর মৃত্যু হয়। তদন্তকারীদের সূত্রেই জানা গিয়েছে, প্রেমিকাকে সঙ্গে নিয়ে অভিযুক্ত কিছু দিন আগে গিয়েছিলেন একটি বাইকের শোরুমে। সেখানে কালীপুজোর দিন বাইক বুক করবেন বলে জানিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। জানা গিয়েছে, বাইক নিয়ে ইন্টারনেটে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করতেন যুবক। দেশি বা বিদেশি, যে কোনও বাইকের বিস্তারিত তথ্য তাঁর ঠোঁটস্থ। পুলিশ সূত্রে খবর, বাইক কেনার তোড়জোড়ের মধ্যেই অন্য কোনও কারণে যুগলের মধ্যে খানিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। টাকা নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোনও বচসা হয়েছিল কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই সাময়িক দূরত্বের সময়ে অন্য কোনও যুবকের সঙ্গে তরুণীর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। টাকা ফেরত নিতে তরুণীকে কোনও ভাবে চাপ দিচ্ছিলেন কি প্রেমিক? সেই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তরুণীর সঙ্গে অভিযুক্তের কথোপকথন পরীক্ষা করে একাধিক তথ্য তদন্তকারীরা হাতে পেয়েছেন বলে খবর। তবে সে বিষয়ে বিস্তারিত এখনই প্রকাশ্যে আনছে না পুলিশ। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার জন্যেও অপেক্ষা করছেন তদন্তকারীরা। ওই রিপোর্ট থেকে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে।

    ঘটনার রাতে একাধিক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছিলেন কৃষ্ণনগরের তরুণী। অভিযুক্ত প্রেমিকও যাঁর যাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন, সব খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার অমরনাথ কে। তিনি আরও জানিয়েছেন, তরুণীর হোয়াট্‌সঅ্যাপ স্টেটাসে যে অডিয়ো ক্লিপ মিলেছে, সেটিও পরীক্ষা করে দেখা হবে। অডিয়ো ক্লিপে যে কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছে, তা ওই তরুণীরই কি না, তা-ও যাচাই করা হবে। তদন্তের অগ্রগতি নিয়েও জানিয়েছেন পুলিশ সুপার। তিনি বলেন, ‘‘ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা এসেছিলেন। তারা বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছেন। বৃহস্পতিবার আমরা আঙুলের ছাপের নমুনা সংগ্রহ করেছি। একটি প্লাস্টিকের বোতলও পাওয়া গিয়েছে। তার মধ্যে হালকা নীলচে রঙের তরল মিলেছে। যাঁরা পরীক্ষা করেছেন, তাঁরা বলছেন যে, ওর ভিতরে কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া গিয়েছে।’’ পুলিশ সুপারের তরফে জানানো হয়েছে, যে জায়গা থেকে তরুণীর দেহ উদ্ধার হয়েছে, সেই জায়গাটিই প্রকৃত ঘটনাস্থল বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তদন্ত শেষ হলে তবেই সবটা নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব। শনি বা রবিবার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলে জানা যাবে, তরুণীকে খুন করা হয়েছে না কি আত্মহত্যা করেছেন তিনি।

    কৃষ্ণনগর-কাণ্ডের তদন্তকারী আধিকারিক বদল করা হল। সুমিত কুমার দে-র জায়গা।য় নিয়ে আসা হল কৌশিক সাউ-কে। সুমিত ছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার। কৌশিক ইন্সপেক্টর।

  • Link to this news (আনন্দবাজার)