ব্রতের অন্যতম আচার ছিল অরন্ধন। একমাত্র দেবসেবা, শিশু ও রোগীর জন্য ছাড়া বাড়িতে উনুন জ্বলবে না। ফলমূল, চিঁড়া-মুড়ি অথবা আগের দিনের পান্তাভাত খাওয়া যাবে। পরিবারের নারীরা ঘট স্থাপন করে হাতে হরীতকী বা সুপারি নিয়ে বঙ্গলক্ষ্মীর কথা শোনার পর সকলে এক সঙ্গে তিন বার বলবেন, “আমরা ভাই ভাই এক ঠাঁই/ ভেদ নাই ভেদ নাই।”
সেই বছর থেকেই শুরু। বঙ্গভঙ্গ রদ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি বছর ঘরে ঘরে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠল শঙ্খধ্বনি, অরন্ধন, পাটালি প্রসাদ আর হাতে হলুদ সুতোর রাখি বেঁধে বঙ্গলক্ষ্মীর আরাধনা। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় তার খবরে বলা হয়েছিল, ৩০ আশ্বিন তারিখে ‘পঞ্চসহস্রাধিক পল্লীরমণী’র সমাবেশে এই ব্রতকথা পাঠ হয়। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে সাধারণ গৃহস্থবাড়ির মহিলাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রচলন হলেও ঘরে-বাইরে সাড়া ফেলে এই নতুন ব্রত। বিশেষ করে অরন্ধনের কৃচ্ছ্রসাধনে এগিয়ে এসেছিলেন মুসলমানরাও। সুকুমার সেনের স্মৃতিকথায় জানা যায় মৌলবি লিয়াকৎ হোসেনের কথা, যিনি সুদূর বিহার শরিফ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন শুধু এই আন্দোলনে যোগ দিতেই। সারা বছর ধরে সপ্তাহের একটি দিনে ছোট মিছিল আয়োজন করা ছাড়াও, ৩০ আশ্বিনে তাঁর ব্রতপালনের কথা উল্লেখ করেছেন সুকুমার সেন। শাসক-বিরোধিতার সুরেই উৎসব পালন বাঙালির ঐতিহ্য। বাংলার মাটিতে এ ভাবেই মানুষের ধর্ম শিকড় পেয়েছে। ছবিতে কুমোরটুলি-পাড়ায় লক্ষ্মীর সরা আঁকছেন শিল্পী, মাঝের ছবিতে কালীঘাট পটচিত্রে লক্ষ্মী, উইকিমিডিয়া কমনস থেকে।
ইন্টার-কলেজ মিউজ়িক কম্পিটিশনে পর পর তিন বছর সেরা, রুপোর তানপুরা হাতে উঠেছিল পুরস্কার হিসেবে। ক্লাসিক্যালে পোক্ত-গলা সেই ছেলেই সে-কালের বোম্বে গিয়ে গোড়ায় সহকারী সঙ্গীত পরিচালকের কাজ করল বেশ কিছু দিন। মহম্মদ রফি তালাত মাহমুদ মুকেশের মতো শিল্পীরা গান-জগতে যখন রাজার রাজা, তখন পায়ের তলার স্রেফ মাটিই নয়, শ্রোতাদের হৃদয়াসনও জয় করেছিলেন প্রবোধচন্দ্র নামের তরুণ শিল্পী— পরবর্তী কালের মান্না দে (ছবি)। সেই আবেগী ইতিহাস বাঙালির অজানা নয়। মান্না দে চলে গিয়েছেন সেও হয়ে গেল এগারো বছর, ১ মে ওঁর জন্মদিনের মতোই ২৪ অক্টোবর ওঁর প্রয়াণদিনটিকেও স্মরণ করে আসছে শহর কলকাতার মান্না দে সঙ্গীত অ্যাকাডেমি। আগামী বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় গ্যালারি চারুবাসনার উপেন্দ্রকিশোর সভাগৃহে অনুষ্ঠান, ‘মান্না দে স্মৃতি বক্তৃতা’য় তৃতীয় বছরের বক্তা অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়; থাকবেন যোগেন চৌধুরী-সহ বিশিষ্টজন।
শহর জুড়ে যে অভূতপূর্ব জনজাগরণ, তা দেখে মনে পড়তেই পারে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস। পরিপ্রেক্ষিত ছিল ভিন্ন, কিন্তু মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও চেতনার প্রকাশ ছিল একই রকম। ১৯০৫-এর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর বাংলা হয়ে উঠেছিল একসূত্র, ব্রিটিশের বাংলা ভাগের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরব। মানুষের প্রতিবাদ রূপ পেয়েছিল শহরের বুকে এক অসাম্প্রদায়িক মিলনকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাবে: তারই ঘনীভূত রূপ ‘ফেডারেশন হল’, ভগিনী নিবেদিতার নামকরণে ‘মিলন মন্দির’। ১৬ অক্টোবর হয় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, দিনটি আজও উদ্যাপন করে ফেডারেশন হল সোসাইটি। গত ১৫ অক্টোবর হয়ে গেল ১২০ বছরের সূচনা-অনুষ্ঠান, গুণিজন-উপস্থিতিতে।
“তাঁর নীতি এবং আদর্শের সামনে, তাঁর নির্লোভ নির্মোহ জীবনের সামনে, তাঁর সততা এবং সারল্যের সামনে শ্রদ্ধায় বারবার আমি মাথা নত করেছি,” অম্লান দত্ত সম্পর্কে লিখেছেন তসলিমা নাসরিন। যোগেন চৌধুরীর কলমে বহুশ্রুত ঘটনাটি: বিশ্বভারতীর উপাচার্য পদে দিনশেষে উপাচার্যের গাড়িটি ফেরত পাঠিয়ে রিকশায় চেপে বসেছিলেন স্টেশনের পথে, কলকাতা ফিরবেন বলে। মফস্সলে এক বাড়িতে আপ্যায়নকালে পুকুরের বড় মাছের সরেস মাথাটি গৃহস্বামী তাঁর পাতে দিতে বলায় খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন, স্মৃতিচারণ সৌভিক দত্তের। শুধু এক শিক্ষক-অর্থনীতিবিদ নন, যুক্তি প্রজ্ঞা মনন ও হৃদয়বত্তার আধার অম্লান দত্তকে স্মরণ করেছে ত্রৈমাসিক পত্রিকা সমতট, সাম্প্রতিক ‘শতবর্ষে অম্লান দত্ত’ সংখ্যায়।
“‘চলেছি চলেছি সরো সরো—’/ ‘যাচ্ছো কোথায়?’ ‘সড়গড়।’/... ছোটো বড় সব্বাই/ সড়গড়তে পায় ঠাঁই।” সেই কবে লিখেছিলেন নবনীতা দেব সেন, ‘সারা বাংলা স্কুল ম্যাগাজ়িন’ সড়গড় নিয়ে। ছোটদের জন্য পত্রিকা এখনও কলকাতা তথা বাংলায় কম নয়, তবে দেখা যায় তার অধিকাংশেই বড়রাই সব লিখে দেন ছোটদের জন্য। সড়গড়-তেও বড়রা আছেন বটে, তবে সামনে ছোটদের লেখা আঁকা ছড়া গল্প কবিতা কৌতুক সব কিছু সামনে এগিয়ে দিয়ে: নিজেরা পিছনে। প্রতিটা স্কুলের নিজস্ব পত্রিকা থাকেই, কিন্তু এমন পত্রিকা পাওয়া যাবে কি আর, যেখানে ছোটদের নানা লেখা ও ছবির মালা গাঁথা হয়েছে এক-একটি স্কুল-পরিচয়ে? সম্প্রতি প্রকাশিত শারদ সংখ্যাটিও বর্ণিল, লিখেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখও।
‘অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবিতে’ ভেদ নেই কলকাতা আর করাচিতে। কোভিড-অতিমারি শুরুর ক’হপ্তা আগে করাচিতে একত্র হন অগণিত নারী, শুরু হয় ‘অওরত মার্চ’। ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে মেয়েদের রাত দখলের মতোই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল সেই জমায়েত ও পদযাত্রা, মেয়েদের নিজস্ব অধিকার বুঝে নেওয়া আর বুঝিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে। কলকাতা কি জানে সেই ইতিহাস? আমাদের সৌভাগ্য, পাকিস্তানের প্রামাণ্যচিত্রকার আনম আব্বাস তাঁর ছবিতে ধরে রেখেছেন সেই আন্দোলন। সেই ছবি— দাগ দাগ উজালা (দিস স্টেনড ডন), দেখানো হচ্ছে শহরে প্রথম বার, পিপল’স ফিল্ম কালেক্টিভ-এর আয়োজনে, ২০ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৫টায় সুজাতা সদনে। ছবি-শেষে হবে আলোচনাও, আর জি কর প্রসঙ্গে বলবেন নারী অধিকার আন্দোলন কর্মীরা।
কলকাতার জনমানসে অটোর ছবিটা উজ্জ্বল নয়। বেপরোয়া চালানো, যাত্রীদের সঙ্গে চালকের দুর্ব্যবহার... অভিযোগের শেষ নেই। নিজস্ব কোনও দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা থেকেই কি অটোচালকরা আগ্রাসী ইমেজ লালন করেন? কলকাতায় যে অটো ব্যবস্থা চালু, তাকে বলা যায় ‘আধা-আইনি’। তিনচাকার বাহন হিসাবে পঞ্জিকরণে অটোর শ্রেণি নির্ণয় থেকে তিনচাকার গাড়িচালকদের লাইসেন্সের গোত্র নির্ণয় পর্যন্ত পুরো ব্যবস্থা জুড়ে আইনি ধোঁয়াশা। অস্তিত্ব রক্ষার্থেই তাই ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে সমর্পণ, বিনিময়ে ইউনিয়নের রাজনৈতিক পেশিশক্তি হয়ে ওঠেন চালকেরা। দেওয়া-নেওয়ার এই সম্পর্কে ধর্ম, ভাষা, সামাজিক বিভাজন দাগ কাটে না। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাসের অধ্যাপিকা শমিতা সেন শ্রম-ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্প্রতি বললেন ‘পলিটিক্স অব ইনফর্ম্যালিটি: অটোরিকশা অপারেটরস অব কলকাতা’ নিয়ে, ইতিহাস চর্চা-গোষ্ঠী ‘ভয়েসেস ফ্রম দ্য পেরিফেরি’র আয়োজনে ওদের ইউটিউব চ্যানেলে।
বইমেলায় দেখা মহিলার সঙ্গে। চেহারা দেখে মনে হয়েছিল আর্থিক সঙ্গতি নেই তত, অথচ ওঁর ব্যাগে লেখকের তিনটে বই, বেশ দামি। বললেন, সারা বছর অল্প অল্প টাকা জমিয়ে মেলায় কিনেছেন। অদূরে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গী ভদ্রলোক, ক্রাচ হাতে, একটা পা বিকল। লেখককে বললেন, “আমি আপনার অনিমেষ।” একদা-নকশাল, পুলিশের মারে একটা পা নষ্ট হয়ে যায়, অনিমেষ-মাধবীলতার মতোই ওঁরা এক সঙ্গে থাকেন! এক সাক্ষাৎকারে এ ঘটনাটি বলেছিলেন সমরেশ মজুমদার (ছবি), বিশ-একুশ শতকের বাঙালির একটা বড় অংশের ঘরবসতি যাঁর বইয়ের সঙ্গে। প্রয়াত লেখকের জীবনের নানা দিক ছুঁয়ে তথ্যচিত্র বানিয়েছেন অশোক বিশ্বনাথন, দ্য ম্যাভেরিক। ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ় অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস ও সাহিত্য অকাদেমির যৌথ উদ্যোগে ছবিটির প্রদর্শন আগামী ২১ অক্টোবর বিকেল ৫টায় নন্দন ৩-এ।
মানুষের মুখে মুখে, হাতে হাতে, পায়ে পায়ে রোজ শহর কলকাতায় তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন শব্দ— বাড়ছে নাগরিক অভিধানের পাতা। পাল্টাচ্ছে পুরনো শব্দেরা, ব্যবচ্ছেদ হচ্ছে তাদের। ‘উৎসব’ বলতেই চোখে আর মনে ভেসে উঠছে ‘শব’, আহত সময়ে বাহুল্যের প্রদর্শন হয়ে উঠছে ‘কার্নিভাল’-এর সমার্থ। সমাজমাধ্যম থেকে শুরু করে পথের স্লোগানে-ব্যানারে নতুন ভাবে চোখ মেলছে বাংলা ভাষা। সাধারণ্যের ভাষা আর লেখক-কবির কলম হাত ধরছে একে অন্যের। পরিচয় পত্রিকার তরফে এরই মধ্যে প্রকাশিত হল দুঃসময়ের ভাষ্য, আর জি কর-এর ঘটনায় শতাধিক লেখকের প্রতিক্রিয়াকে দু’মলাটে গেঁথে। এমন স-শব্দ প্রতিবাদ, কোনও ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটা বইয়ের গড়ে ওঠা কলকাতা দেখেছে আগেও, সে অর্থে হয়তো তা নতুন নয়। কিন্তু পথচারী থেকে কবির মুখে শব্দের এই নিরর্গল রূপ-রূপান্তর যে অভিনব, তা নিয়ে সংশয় নেই।