• রাজ্যে বাল্যবিবাহের হার ৪২ শতাংশ, বিয়ে আটকাতে জোর প্রশাসনের
    এই সময় | ১৯ অক্টোবর ২০২৪
  • আজ থেকে ১৬৮ বছর আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘বিধবা বিবাহ আইন’ ব্রিটিশ সরকারকে দিয়ে পাশ করাতে সফল হয়েছিলেন। তাঁর এমন উদ্যোগের বহু কারণের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল তৎকালীন বাংলায় কচি বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া। সেই বাংলার সঙ্গে বর্তমান বঙ্গসমাজের কোথাও তেমন মিল না থাকলেও বাল্যবিবাহের অভিশাপমুক্ত এখনও হয়নি আমাদের রাজ্য।পরিসংখ্যান বলছে, এই রাজ্যে বাল্যবিবাহের হার প্রায় ৪২ শতাংশ যা জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেকটাই বেশি। ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে ২০১৯-২১’ অনুযায়ী পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও পূর্ব বর্ধমানে বাল্য বিবাহের হার ৫০ শতাংশের উপরে! সর্বোচ্চ ৫৬ শতাংশ দুই মেদিনীপুরে, যেই বীরসিংহ গ্রামের সন্তান বিদ্যাসাগর।

    কেন বাংলায় এখনও উল্লেখযোগ্য ভাবে নাবালিকা বিয়ে আটকানো যাচ্ছে না, তার স্পষ্ট কোনও ব্যাখ্যা প্রশাসনের কাছে নেই। তবে তারা যেনতেনপ্রকারেণ এই সংখ্যা কমাতে চাইছে। আর তা সাম্প্রতিক কোনও উদ্যোগ নয়, প্রায় ১১ বছর আগে থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই পদক্ষেপ করেছেন। ২০১৩ সালে তিনি রাজ্যে ১৩-১৮ বছর বয়সি স্কুলছাত্রীদের জন্য ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প শুরু করেন।

    সেখানে ১৮ বছর বয়স হলে এককালীন ২৫ হাজার টাকা অবিবাহিত মেয়েদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে। তার আগে বছরে হাজার টাকা করে দেওয়া হয় ছাত্রীদের। এই ‘ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফার’ প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল মেয়েদের স্কুলছুট ও অপরিণত বয়সে বিয়ে আটকানো। পরিসংখ্যান বলছে করোনার আগে পর্যন্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় রেজিস্ট্রেশনের নিরিখে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিশ্লেষকদের অনেকেরই মত, এককালীন ২৫ হাজার টাকা কম নয়। ফলে সেটার কিছুটা প্রভাব তো আছেই মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে অল্পবয়সে বিয়ে আটকানোর ক্ষেত্রে।

    তবে তা সত্ত্বেও আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। সূত্রের খবর, গত বছর অর্থাৎ কন্যাশ্রীর দশম বার্ষিকীতে এই প্রকল্পকে আরও কী করে আকর্ষক করা যায়, তার একটি রিভিউ করার সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি ডেটা সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করে সরকার দেখছে যে কোথায় খামতি রয়েছে ও কোথায় ফল মিলেছে। একটি সূত্রে দাবি, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানেও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এমন প্রকল্প রয়েছে। তবে এনএফএসএইচ ৫-এর তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে ওই দুই রাজ্যে ২০১৫-১৬ তে নাবালিকা বিয়ের যা হার ছিল তার থেকে প্রায় অর্ধেক হয়েছে। অথচ বাংলায় তা নয়। সে জন্যই আরও কোমর বেঁধে নেমেছে প্রশাসন।

    কন্যাশ্রী ক্লাব যে সব জেলায় রয়েছে, তাদের আরও সক্রিয় করা হচ্ছে। এই ক্লাবগুলি স্কুলের স্টুডেন্টদের নিয়ে তৈরি হয়। তারা বাল্যবিবাহের খবর পেলে নয় স্কুলের প্রধান, না হয় পুলিশ, বিডিও, প্রশাসনিক হেল্পলাইন নম্বরে জানিয়ে যা আটকাতে চেষ্টা করে। বহু ক্ষেত্রেই তারা সফল হয়। বন্ধুকে ফের ফিরিয়ে আনে স্কুলে।

    এর বাইরে রয়েছে স্বয়ংসিদ্ধা প্রকল্পও। ২০১৬ সালে রাজ্য পুলিশের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই ‘প্রিভেন্টিভ ক্যাম্পেন’ মাঝে নানা কারণে থিতিয়ে গেলেও ফের প্রাণ পাচ্ছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হলো, বাল্যবিবাহ, শিশুপাচার ও শিশুশ্রম প্রতিরোধ করা। এ ক্ষেত্রে একজন পুলিশ কোনও এনজিও-কে পার্টনার করে স্কুলে স্কুলে এগুলো নিয়ে সচেতনতা শিবির করে। তার পর তৈরি হয় স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্বয়ংসিদ্ধা গ্রুপ। স্কুল-অঞ্চলে বিভিন্ন বাড়ি গিয়ে এই গ্রুপ কাউন্সেলিং করে, যাতে আটকানো যায় এই অপরাধ। শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টও রায় দেওয়ার সময়ে বলেছে যে, ‘পুলিশ কেস করে কিছু লাভ হবে না। প্রিভেনশন জরুরি। অর্থাৎ আটকে দিতে হবে।’ এ কথা রাজ্য প্রশাসন আরও ৮ বছর আগেই ভেবেছিল। পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার দাবি, ‘এই ধরেন প্রতিরোধমূলক স্কিম’ অন্য কোনও রাজ্যে নেই।

    এ ছাড়া রয়েছে সবুজসাথী, রূপশ্রী প্রকল্প। মেধার ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপও। বিশেষ করে গরিব পরিবারের মেয়ের বিয়ে ১৮ বছরের পরে দিলে তাতে সরকার ২৫ হাজার টাকা নগদ সহায়তা দেয়।

    রাজ্য সরকারের সদিচ্ছার যে কোনও অভাব নেই এই প্রবণতা আটকাতে তার প্রমাণ বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের নিজস্ব উদ্যোগ। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলি, দক্ষিণ দিনাজপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আলাদা আলাদা নানা উদ্যোগ রয়েছে। কোথাও স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে কাজে লাগানো হয়, কোথাও যান আশাকর্মীরা, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রেও বারবার বলা হয় বাল্যবিবাহ ও কিশোরী অবস্থায় মা হওয়ার বিপদ, বিভিন্ন সরকারি স্কুলও আলাদা উদ্যোগ নেয়, কোথাও কোথাও হয় বিশেষ ওয়ার্কশপ যেখানে এই সব বিষয়ে সচেতন করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে জেলা প্রশাসন পুরোহিত ও মৌলবীদেরও সচেতনতা প্রচারে কাজে লাগিয়েছে।

    রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ আধিকারিক বললেন, ‘আমরা মনে করি ওঁরা যে হেতু বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেন, তাই তাঁদের সচেতনতা প্রচারে ব্যবহার করলে কাজ হবে।’ তিনি জানান, মৌলবী-পুরুতরা নিজেরাও জানিয়েছেন, ১৮-র আগে বিয়ে তাঁরা দেবেন না।

    এর বাইরে রয়েছে পুলিশের ভূমিকা। অনেক জায়গায় যেমন বাল্যবিবাহের খবর পেলে তা আটকে দিয়ে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হয়, তেমনই বহু জেলাই এখন ‘বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন ২০০৬’-এ মামলা করছে। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে ছেলেমেয়েদের অভিভাবককে বা বর সাবালক হলে তাঁকেও।

    পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও গ্রামীণ জীবিকা মিশনের আনন্দধারা প্রকল্পের অধীনে থাকা মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির সাহায্যে নতুন উদ্যমে সমাজের বিভিন্ন কুপ্রথা দূরীকরণে প্রচারে নামতে ইতিমধ্যেই ইউনিসেফের সহায়তায় বাল্যবিবাহ রুখতে শিশু-বান্ধব সঙ্ঘ তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে নিয়মিত আলোচনা, স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির নজরদারি ও নাবালিকাদের অঞ্চলভিত্তিক অবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য খুব তাড়াতাড়ি একটি ব্যবস্থা আনা হচ্ছে।

    এ সব কিছুর পরেও কেন বালিকা বধূর সংখ্যা কমছে না রাজ্যে? তা নিয়ে সরাসরি মন্তব্য না করলেও এক প্রশাসনিক কর্তা বললেন, ‘চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো বিয়ে আটকানো যাচ্ছে না, তবে প্রশাসন সতর্ক। পরিবর্তন আসবেই।’ তিনি জানালেন, কন্যাশ্রী প্রকল্পকে প্রয়োজনে ঢেলে সাজা হবে। আর্থিক সুবিধা বাড়ানো যায় কি না তা নিয়েও আলোচনা হবে। আরও কিছু পরিকল্পনাও মাথায় আছে। বললেন, ‘আমরা আগামী ৫ বছরের লক্ষ্যমাত্রা রেখেছি। জাতীয় গড়ের থেকেও কম হবে বাংলার গড়। আর একটু ধৈর্য ধরুন।’
  • Link to this news (এই সময়)