আপনার অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে কোটি টাকা, পাচার হচ্ছে চিনে!
এই সময় | ২০ অক্টোবর ২০২৪
চিত্রদীপ চক্রবর্তী
গেমিং অ্যাপের মাধ্যমে যে কোটি কোটি টাকার প্রতারণা চলছে শহরে, তার খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল বছর দুয়েক আগে, গার্ডেনরিচে। ‘ই-নাগেটস’ নামে একটি চাইনিজ অ্যাপ ব্যবহার করে ব্যবসায়ী আমির খান প্রতারণা থেকে রোজগার করেছিলেন প্রায় ১৭ কোটি টাকা। শাহি আস্তাবল গলির একটি ছোট্ট ঘরের খাটের নীচ এবং আলমারি থেকে থরে থরে নোট বাজেয়াপ্ত করেছিলেন ইডির গোয়েন্দারা। সেই তদন্ত এখনও চলছে। তবে এরই মধ্যে ব্যারাকপুর সাইবার ক্রাইম শাখার গোয়েন্দারা জানতে পারলেন লোককে বোকা বানিয়ে তাদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কী ভাবে কোটি কোটি টাকা চিনে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।এই চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করার পরে পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হয় পুলিশের কাছে। সাইবার বিশেষজ্ঞ তথা আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘ভারতীয় টাকা ‘বাইনান্স’ নামে একটি অ্যাপের মাধ্যমে ক্রিপ্টো কারেন্সিতে কনভার্ট করে তা একটি ওয়ালেটে জমা করত প্রতারকরা। তারপর তা পাঠিয়ে দেওয়া হতো চিনে। এই চক্রের মাথা একজন চিনা তরুণী। তাঁকে কী ভাবে ধরা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।’
ব্যারাকপুরের ঘটনাটির মোডাস অপারেন্ডি দেখেও তাজ্জব বনে গিয়েছেন তদন্তকারী অফিসারেরাও। তাঁদের কথায়, ‘কিছু দিন আগে পর্যন্ত কলকাতা এবং শহরতলির একাধিক জায়গায় হানা দিয়ে নগদ টাকা উদ্ধার হচ্ছিল। তবে যাদের বাড়ি থেকে এ সব টাকা পাওয়া যাচ্ছিল, তারা প্রায় প্রত্যেকেই কমিশন এজেন্ট। অর্থাৎ মোট টাকার দুই অথবা পাঁচ শতাংশ কমিশনের ভিত্তিতে কাজ করে থাকে এরা। ফলে এদের ধরলে কোনও লাভ হতো না। একই সঙ্গে এই এজেন্টরা সতর্ক হয়ে যায়, কারণ যে টাকা ঘরে আসত তার পুরোটাই প্রায় কেন্দ্রীয় সংস্থার হানাদারিতে বাজেয়াপ্ত হচ্ছিল।’
সম্প্রতি ব্যারাকপুর পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। তদন্তে নেমে জানা যায়, ধীমান ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তি অভিযোগকারীকে জানান, তিনি বিভিন্ন ব্যাঙ্কের সঙ্গে টাই-আপ করে একটি অ্যাপ চালান। মোটা টাকার কমিশনের ভিত্তিতে অভিযোগকারী সেই ব্যবসায় যুক্ত হতে পারেন। এরপর দু’জন ওই এলাকার একটি হোটেলে দেখা করেন। সেই সময়ে ধীমানের নির্দেশে কমিশনের লোভে প্রতারিতের মোবাইলে সেই অ্যাপ ইনস্টল করা হয়। অ্যাপের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সংযোগও করানো হয়েছিল। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযোগকারী ব্যবসায়ী দেখতে পান তাঁর অ্যাকাউন্টে এক কোটি টাকা জমা হয়েছে। এবং ওয়ালেটের মাধ্যমে তা সরিয়েও নেওয়া হয়েছে। ভয় পেয়ে গিয়ে তিনি পুলিশের দ্বারস্থ হন।
তদন্তকারীরা জানতে পারেন, ওই টাকা একটি ওয়ালেটের মাধ্যমে ‘বাইনান্স’ অ্যাপে ট্রান্সফার করিয়ে তা ক্রিপ্টো কারেন্সিতে কনভার্ট করে আবার অন্য একটি ওয়ালেটের মাধ্যমে চিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় যাদবপুরের বাসিন্দা ধীমান ছাড়াও পূর্ব মেদিনীপুরের সৌরভ কর এবং দমদমের বাসিন্দা সুমিত করকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিভাসের বক্তব্য, ‘বিভিন্ন চাইনিজ গেমিং অ্যাপ এবং ইনভেস্টমেন্ট স্কিমের লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে যে টাকা উপার্জন করা হয় তা ওই বিশেষ একটি অ্যাপের মাধ্যমে অন্য কারও অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত করে সেখানে জমা করা হয়। এই অ্যাপ এপিকে নামে পরিচিত। এই অ্যাপ ইনস্টল থাকলে, ব্যবহারকারীর অজান্তেই তার বিভিন্ন তথ্য জানতে পারে প্রতারককা। সেই অ্যাপ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় টাকা। অনেকেই না জেনে বুঝে কিছু টাকা কমিশন পাওয়ার আশায় নিজেদের অ্যাকাউন্টকে বিপদের মুখে ফেলেন।’
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এটা টাকা পাচার করার একটা নতুন পদ্ধতি। ফলে অচেনা কাউকে নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে দেবেন না। পুলিশ তদন্তের প্রয়োজনে আপনার ব্যাঙ্কের খাতা ফ্রিজ় করে দিতে পারে। এমনকী জেলেও যেতে হতে পারে আপনাকে।’