বিশ্বাসে ভর করেই চলে বিক্রেতাহীন দোকান, মূল্য রেখে দিয়ে যান ক্রেতারা
বর্তমান | ২১ অক্টোবর ২০২৪
সংবাদদাতা, রামপুরহাট: আজকের দিনে যেখানে ‘হয় কথায় নয় কথায়’ প্রতারণার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ, সেখানে একটা গোটা দোকান চলছে শুধুমাত্র বিশ্বাসের উপর ভর করে। ভাবা যায়! সেই দোকানে বিক্রেতা থাকেন না। ক্রেতারা কিন্তু সঠিক মূল্য রেখে দিয়ে যান। জানতে চান এমন দোকান কোথায় আছে? মল্লারপুরে এলেই দেখতে পাবেন সেই দোকান। মল্লারপুর স্টেশনে রয়েছে রাজুর খবরের কাগজ, ম্যাগাজিনের স্টল। কিন্তু সেখানে রাজুর দেখা মেলে কচ্চিৎ, কদাচিৎ। স্টল ফাঁকাই থাকে। খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন সাজানো থাকে স্ট্যান্ডে। ক্রেতারা সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কাগজ বা ম্যাগাজিন নিয়ে নির্দিষ্ট মূল্য রেখে দিয়ে যান।
মল্লারপুরের বাসিন্দা রাজু লেটের বয়স আটত্রিশের আশপাশে। অবিবাহিত। বাড়িতে বাবা, মা, ভাই, ভাইয়ের বউ তাঁর ও তাঁদের সন্তানরা রয়েছে। যৌথ পরিবার। ছোট থেকেই খেলাধুলোর প্রতি আকর্ষণ রাজুর। সেই সময়ে বিভিন্ন কাগজে, পত্রিকায় খেলার খবর পড়ার নেশা ছিল তাঁর। সেই নেশাকেই পরবর্তী সময়ে পেশায় পরিণত করেছেন তিনি। প্রায় ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মল্লারপুর ফুটব্রিজের নীচে খবরের কাগজ বিক্রি করে আসছেন। ভোর পাঁচটা থেকে তাঁর লড়াই শুরু হয়। ট্রেন থেকে খবরের কাগজ নামিয়ে ফুটব্রিজের নীচে একটি কাঠের টেবিলে সাজিয়ে রাখেন। এরপর তিনি চলে যান বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ পৌঁছে দিতে। সকাল দশটার মধ্যে বিলি করার কাজ সেরে তিনি যখন স্টেশনে পৌঁছন দেখেন একটিও কাগজ নেই। কিন্তু কখনও তাঁকে খবরের কাগজের দাম নিয়ে ভাবতে হয়নি। সব সময় তিনি সঠিক মূল্যই পেয়েছেন। রাজুর কথায়, খেলার নেশা ছাড়তে পারিনি। আজও পাঠকদের বাড়ি বাড়ি কাগজ পৌঁছে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতে চলে যাই। আবার আয় বাড়াতে ক্যাটারিংয়ের কাজও করি। তাই খবরের কাগজের স্টলে থাকতে পারি না। তিনি বলেন, এই ব্যবসার মূল ভিত্তি হল সততা। তাছাড়া শিক্ষিত মানুষরা কাগজ পড়েন। তাঁরা ঠিকই টাকা রেখে যান। অনেক সময় ক্রেতার কাছে খুচরো টাকা থাকে না। প্রয়োজন ক্রেতারা টেবিলে টাকা রেখে ব্যালেন্স নিজেরাই ফেরত নিয়ে যান। অনেকে সাতদিন টানা কাগজ নিয়ে যান। সপ্তাহের শেষে হিসেব করে টাকা রেখে যান। আবার কেউ আমাকে দেখতে পেয়ে ‘কাগজ নিয়েছি’ বলে টাকা দিয়ে যান। এখানে কোনও ক্যামেরা লাগানো নেই। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটিও টাকাও মার যায়নি। সততার নীতি এই ক্ষেত্রে একশো শতাংশ সফল। সদাহাস্য রাজু সকল নিত্যযাত্রীর কাছে প্রিয়। বৃদ্ধ থেকে কলেজ পডুয়া সকলেই তাঁকে এক ডাকে চেনেন।
বর্তমান বিশ্বে যখন যাবতীয় মূল্যবোধ হারিয়ে যেতে বসেছে, তখন রাজুর দোকান ব্যতিক্রম। ক্রেতা অর্জুন শর্মা বলেন, মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে স্টেশন থেকে খবরের কাগজ নিয়ে বাড়ি ফিরি। রাজু থাকে না, টাকা টেবিলে রেখে দিয়ে আসি। কলেজ পডুয়া অনন্যা বিশ্বাস বলেন, রাজুদা কর্মখালি সংক্রান্ত কাগজপত্রও রাখেন। আমরা টাকা রেখে সেই কাগজ নিয়ে চলে যাই। কখনও আবার একমাসের টাকা একসঙ্গে রেখে যাই। এখানে অনলাইন পেমেন্টের ব্যবস্থা নেই। পুরোটাই ক্যাশে। ট্রেন ধরতে আসা ইয়াকুব হোসেন বলেন, মল্লারপুর স্টেশন যেন এক টুকরো সুইজারল্যান্ড। সেখানেও এরকম বিক্রেতাহীন দোকান রয়েছে। বিশ্বাসে ভর করে খবরের কাগজ বিক্রির এমনই নজিরবিহীন স্ট্যান্ড তৈরি করেছেন রাজু।