হাজার বছর আগে বল্লাল সেনের গুরুদেব বনকাটিতে তন্ত্রমতে কালীপুজো শুরু করেন
বর্তমান | ২১ অক্টোবর ২০২৪
নিজস্ব প্রতিনিধি, বনকাটি: প্রায় হাজার বছর আগের ঘটনা। জলপথে রাজা বল্লাল সেন তাঁর গুরুদেব মহেশ্বর প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আসছিলেন। সাতকাহনিয়ার কাছে অজয় নদ লাগোয়া গভীর জঙ্গলে নেমে পড়লেন গুরুদেব মহেশ্বর। মহারাজাকে জানালেন এখানেই তিনি তন্ত্রসাধনা করে বসবাস করবেন। প্রথমে দীর্ঘ তপস্যা, তারপর ঘটা করে কালীপুজোর আয়োজন করলেন বল্লাল সেনের গুরুদেব। বনকেটে জনপদ তৈরি করায় গ্রামের নাম হল বনকাটি। মহেশ্বরবাবুর শুরু করা তন্ত্রমতে কালীপুজো আজও ঘটা করে হচ্ছে কাঁকসা থানার বনকাটি গ্রামে। বহু শতাব্দী প্রাচীন নানা মন্দির ঘেরা পঞ্চমুণ্ডির আসন দেখলে আজও গা ছমছম করে। সামনে রয়েছে বিশাল যজ্ঞকুণ্ড। এক সময়ে নরবলির বিধান ছিল তাই আজও তান্ত্রিক বংশের কোনও এক সদস্যের রক্ত আহুতি দিতে হয় মা কালীকে। এক হাজার বছরের পুরনো এই পুজো ঘিরে পার্শ্ববর্তী বহু গ্রামের মানুষের উৎসাহ। পুজোর সময়ে মন্দির চত্বরে তিল ধারণের জায়গা থাকে না।
সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েছে বনকাটির এই কালী মন্দির চত্বরে। মহেশ্বর প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার ইংরেজ আমলে কোনও পরাক্রম দেখানোর জন্য রায়বাহাদুর উপাধি পান। সেই থেকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের বদলে এই কালী রায় পরিবারের কালী রূপেই খ্যাতি পায়। মন্দির চত্বরে গেলে ডুব দেওয়া যায় কয়েকশো বছর আগের ইতিহাসের পাতায়। পুরো এলাকা ঘিরে রয়েছে প্রাচীন গাছপালায়। মায়ের মন্দির ঘিরে বহু শতাব্দী প্রাচীন শিব ও বিষ্ণু মন্দির। খেলার পুতুল থেকে হীরক জয়ন্তি, আলো সহ নানা সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে এই মন্দির চত্বরে। মন্দির চত্বরের পূর্ব দিকেই ৫০০ বছরের পুরনো চাকলতা গাছ। এরই তলায় বাবা ভৈরব মহাদেবের অবস্থান। কালী মন্দিরের সামনে দক্ষিণ অভিমুখে একটি বিষ্ণু মন্দির ভগ্নপ্রায় হয়ে পড়ে রয়েছে। রায় পরিবারের দাবি, বিষ্ণু মন্দিরটিও এক হাজার বছরের বেশি পুরনো ছিল। সেই মন্দির জীর্ণ হওয়ায় আরও একটি বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ হয়। সেটিও ৩০০ বছরের বেশি পুরনো। কালী মন্দিরের দক্ষিণ দিকে তিনটি শিব মন্দির ও পশ্চিম দিকে দুটি শিব মন্দির রয়েছে। প্রতিটিতে টেরাকোটার অপূর্ব কাজ। কালী মন্দিরটি সংস্কার করা হলেও তার প্রাচীন নমুনা অক্ষুন্ন রাখা হয়েছে। এখানে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার হয়েছে পাথরের বলিদানের হাড়িকাঠ।
পুজোতেও রয়েছে নানা বিশেষত্ব। আজও পুজো শুরুর আগে রায় পরিবারের এক সদস্যকে শ্মশানে গিয়ে বিনাবস্ত্রে তন্ত্র সাধনার বিশেষ কিছু উপাচার পালন করতে হয়। বিশাল যজ্ঞকুণ্ডে রায় পরিবারের নামেই ১০০৮টি বেলপাতা উৎসর্গ করা হয়। অন্যান্য যাঁদের মানত থাকে, তাঁরাও বেলপাতা দেন। প্রায় আড়াই হাজার বেলপাতা ৬ কেজি ঘি ও বিপুল কাঠ সহযোগে সারারাত ধরে যজ্ঞ হয়। মহেশ্বর প্রসাদের দেওয়া বিশেষ মন্ত্রই যজ্ঞে উচ্চারিত হয়। ছাগ, মেষ ও মহিষ বলিদান হয়। নানা নৈবেদ্যর পাশাপাশি মাছের টক ও মাংসের ঝোল মাকে নিবেদন করা হয়। পাশাপাশি পরিবারের যে সদস্য পুজোয় বসেন, তাঁকে বেলকাঁটায় হাত ফুটিয়ে রক্ত নিবেদন করতে হয়।
রায় পরিবারের বর্ষীয়ান সদস্য অনিলকুমার রায় বলেন, বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি ছিলেন জয়দেব। তাঁর সময় কালই ৯৭০ বছর পুরনো সেই অঙ্ক কষেই আমরা দাবি করছি, মায়ের পুজো এক হাজার বছরের বেশি পুরনো। এছাড়া মন্দিরগুলির প্রাচীন ধ্বংসাবশেষই জলন্ত প্রমাণ। আজও একই রীতিতে এখানে পুজো হয়ে আসছে। যম দ্বিতীয়ার পরদিন গ্রামবাসীরা মায়ের বিসর্জন করেন।