কর্মে বিরতি! প্রাইভেটে নয়, ৫৬৩ জন সরকারি ডাক্তারের চুটিয়ে প্র্যাকটিস নার্সিংহোমে, শুধু স্বাস্থ্যসাথীতে আয় ৫৪ কোটি
বর্তমান | ২১ অক্টোবর ২০২৪
নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: কর্মবিরতি। প্রথমে পূর্ণ। তারপর আংশিক। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দরজায় মোটামুটি তালা দিয়ে এভাবেই কাটল দুটো মাস। ধর্না, অবস্থান, বিক্ষোভ, আর অনশন। আগস্ট থেকে অক্টোবর—রাজ্যের গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষের ভোগান্তির টাইমলাইন। কিন্তু নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, ‘কর্মবিরতি’র এই অচলাবস্থা শুধু সরকারি ক্ষেত্রে। আন্দোলনের পথেঘাটে সুর চড়ানো বহু সরকারি ডাক্তারই কিন্তু ৯ আগস্ট থেকে ১৭ অক্টোবরের এই সময়সীমার মধ্যে চুটিয়ে প্র্যাকটিস চালিয়েছেন বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে। এমনই ৫৬৩ জন সরকারি সিনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তারের তালিকা সংগ্রহ করেছে ‘বর্তমান’। তাতে সাফ দেখা যাচ্ছে, এই সময়সীমার মধ্যে তাঁরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৭৩ হাজার ৯০৫টি কেস হ্যান্ডল করেছেন (রোগী দেখেছেন বা অস্ত্রোপচার করেছেন)। নজর করার মতো বিষয় হল, প্রায় ৭৪ হাজার এই ‘কেস’ শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসাথীর ক্ষেত্রে নথিভুক্ত হয়েছে। আর এর থেকে উল্লিখিত ৫৬৩ জন ‘এসআর’ (বন্ডের শর্তে নিযুক্ত জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশ) রোজগার করেছেন ৫৪ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা। গড় হিসেব প্রায় ১০ লক্ষ টাকা। মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় নথিভুক্ত ‘কেস’ ছাড়াও তাঁরা রোগী দেখেছেন। পারিশ্রমিকও পেয়েছেন। একইসঙ্গে রয়েছে মাসে ৬৫ থেকে ৭৫ হাজার টাকার সরকারি ভাতা, যা এমডি, এমএস পাশ করে সরকারি হাসপাতালে যোগ দেওয়ার পর তাঁরা পেয়ে থাকেন। তার হিসেব কিন্তু ৫৪ কোটি ৩৯ লক্ষের মধ্যে ধরা হয়নি।
এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় দেড় হাজার সিনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তার কাজ করেন। লাগাতার কর্মবিরতিতে গেলেও রাজ্যের কাছে তাঁরা কিন্তু ভাতা বন্ধের আবেদন জানাননি। উল্টে তাঁদের বড় একটা অংশ প্রাইভেটে চিকিৎসা চালিয়ে গিয়েছেন। ‘সমাজ সংস্কারক’দের একটা মুখ দেখা গিয়েছে আন্দোলন মঞ্চে, অবস্থানে, মিছিলে। আর একটা মুখ প্রাইভেট হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে। কারণ বেসরকারি ক্ষেত্রে লাগাতার অচলাবস্থা চলতে পারে না। টাকা দিয়ে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অচলাবস্থা মানবেন না রোগীরা। তাই বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোম উপচে পড়েছে ‘আন্দোলনকারী’ বহু ডাক্তারের মহানুভবতায়। এমনকী উত্তরবঙ্গের ‘এসআর’ দক্ষিণবঙ্গের দূরবর্তী জেলার নার্সিংহোমে গিয়ে ‘কেস’ করে এসেছেন—এমন তথ্যও রয়েছে ‘বর্তমান’-এর কাছে। সেইবেলা কেন তাঁদের মনে হয়নি, ‘জাস্টিস’ চেয়ে কর্মবিরতির খাঁড়া শুধুমাত্র সরকারি হাসপাতালের গরিব রোগীদের উপর নামানো ঠিক হচ্ছে না? প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নার্সিংহোমে ইট পেতে বসাটা আন্দোলনের আদর্শ বিরোধী নয়! অথচ, এই পর্বে কলকাতা, জেলার শহর বা শহরতলির বড়-মেজ-ছোট এমন কোনও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে সরকারি হাসপাতালের ‘প্রতিবাদী’দের একটা বড় অংশ প্র্যাকটিস করেননি। তাও আবার করেছেন যে স্বাস্থ্যদপ্তরের প্রতি তাঁদের তীব্র ক্ষোভ, তাদেরই স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে। উল্লেখযোগ্য বিষয়, এই ৫৬৩ জন ‘এসআর’ কিন্তু জানেন, তাঁরা বাইরে প্র্যাকটিস করতেই পারেন না। মজার ব্যাপার, বহু ‘বিপ্লবী’ সিনিয়র ডাক্তার পরিচালিত প্রাইভেট নার্সিংহোম-হাসপাতালে তাঁরা কেস করে এসেছেন।