• জ্যান্ত উট এনে সিন্ধু সভ্যতার থিম, জট আদালতে
    এই সময় | ২১ অক্টোবর ২০২৪
  • পুজো এ বার ২৫ বছরে। তাই বোধহয় পুজো কমিটি ফিরতে চেয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২,৫০০ বছরে। শিল্পীর হাতে একটু একটু করে সেজে উঠেছিল থিমের মণ্ডপ, ঠিক যেন এক টুকরো মহেঞ্জো দারো। তবে শুধু ইট-বালি-পাথরে কি আর শিল্পে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়? তাই হুগলির বৈদ্যবাটি নার্সারি রোড বারোয়ারি দুর্গাপুজো কমিটি অর্ডার দিয়ে ওডিশা থেকে হাজির করেছিল জ্যান্ত উট! ৫ থেকে ১২ অক্টোবর, পুজোর কয়েকটা দিন ওই থিমের মহেঞ্জো দারোর পাশেই মুখে বিশেষ জাল লাগানো অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল সে। পাড়ার ছেলে-বুড়ো, কাকিমা-দিদিমা, উৎসাহী-দর্শনার্থী — সবাই দেখেছে তাকে। যমালয়ে জীবন্ত মানুষের মতো প্রচার চলেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। দোরগোড়ায় জীবন্ত উট।বিন্দুতে বিন্দুতে যেন সিন্ধু সভ্যতা!

    কিন্তু বাধ সাধল দেশের আইন। হরপ্পা-মহেঞ্জো দারোর সময়ে উটদের জন্য আইন ছিল না ঠিকই। কিন্তু তার পর তো সাড়ে চার হাজার বছর পেরিয়ে গিয়েছে। ভারতবর্ষে উট এখন খাতায়কলমে ‘ডোমেস্টিক অ্যানিম্যাল’। ইচ্ছেমতো তাকে কোথাও থেকে এনে মনোরঞ্জনের জন্য বসিয়ে রাখা যায় না। তাই পুজোর এমন ‘লাইভ’ থিম একাধিক পশুপ্রেমী সংগঠনের চোখে পড়তে ১০ অক্টোবর, সপ্তমীর দিনই কেপ ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থার তরফে অভিযোগ দায়ের হয় শেওড়াফুলি থানায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালিখি শুরু করেন অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্ররা।

    দশমী পর্যন্ত উটটি মণ্ডপের পাশেই ছিল। এর মধ্যেই উটের মালিককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শনিবার হুগলি জেলা আদালতে মামলাটি উঠলে বিচারক ধৃত ব্যক্তিকে ১ হাজার টাকা বন্ডে জামিন দেওয়ার পাশাপাশি উটটিকে দ্রুত একটি পশু হাসপাতালে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশও দেন। সেই মতো রবিবার সকালে পুলিশের উপস্থিতিতে উটটিকে পশু হাসপাতালের কর্মীদের হাতে তুলে দেন পুজোর ক্লাবের সদস্যরা।

    সেটাই বা সহজে হলো কই?

    মা কৈলাসে পাড়ি দিয়েছেন এক সপ্তাহ হলো। কিন্তু মায়ের পুজোর ‘লাইভ’ থিমকে কাছছাড়া করতে নারাজ বৈদ্যবাটি নার্সারি রোড। সপ্তাহ তিনেক মরুভূমির জাহাজকে বাড়ির পাশে দিনভর জাবর কাটতে দেখে মায়া পড়ে গিয়েছিল পাড়ার লোকেদের। এ ভাবে পুজোর থিমের নাম করে, কোনও সরকারি অনুমতি ছাড়া ভিনরাজ্য থেকে উট এনে যে মণ্ডপের পাশে বেঁধে রাখা যায় না — এ সব আইনি সমীকরণ বুঝতেই চাননি তাঁরা।

    রবিবার সকালে যখন পুলিশ উটটিকে নিয়ে যেতে বৈদ্যবাটিতে হাজির হয়, তখন পাড়ার বেশ কিছু লোকজন বাধা দেন। কান্নাকাটি জুড়ে দেন মহিলারা, কাঁদতে থাকে বাচ্চারাও। ঝামেলার সময়ে হাত পড়ে এক সংবাদকর্মীর গায়েও। দীর্ঘ টানাপড়েনের পরে উটটিকে লরিতে চাপিয়ে ছায়া অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার হাসপাতালে পাঠায়। ওই হাসপাতালের তরফে সম্রাট মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে পুলিশ উটটিকে আমাদের কাছে পাঠাচ্ছে বলে জেনেছি। পরবর্তী নির্দেশ হওয়া পর্যন্ত আমরা ওকে রেসকিউ সেন্টারেই রাখব।’

    ওডিশা থেকে আনা ওই উটের মালিক এ বার নিজের পোষ্যকে ফিরে পেতে ক্লাবের কর্তাদের হাতেপায়ে ধরছেন। পুজোর ক’দিনে তাঁর যা আয় হয়েছে, উটটি সঙ্গে না থাকলে তার কিছুই হবে না। উল্টে অন্ন সংস্থান বন্ধের উপক্রম হবে। সংশ্লিষ্ট ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘আমরা বেআইনি কোনও কাজ করিনি। উট কোনও বন্যপ্রাণী নয়। তাই বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত আইন এক্ষেত্রে কার্যকর হবে না। ওই প্রাণীটিকে দিয়ে আমরা ব্যবসায়িক কাজও করাইনি। আমরা আইনি লড়াই লড়ব, উচ্চ আদালতে যাব।’

    আইন কী বলছে?

    উট সত্যিই কোনও বন্যপ্রাণী নয়। কিন্তু ‘গৃহপালিত প্রাণী’ হওয়ার সুবাদেও তার কিছু আইনি রক্ষাকবচ এদেশে আছে। প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস অ্যাক্ট (১৯৬০), পারফর্মিং অ্যানিম্যালস রুলস (১৯৭৩) এবং ট্রান্সপোর্ট অফ অ্যানিম্যালস রুলস (১৯৭৮) মেনেই উটকে কোনও অনুষ্ঠান বা মনোরঞ্জেনর কাজে ব্যবহার করা যায়।

    রাজ্য প্রাণিসম্পদ দপ্তরের সচিব বিবেক কুমারের কথায়, ‘প্রতি বছর যখন পশ্চিমবঙ্গে রাজস্থান উৎসব হয়, তার আগে সেখান থেকে উট আনার জন্য আমাদের কাছে অনুমতি নেওয়া হয়। ওই প্রাণীদের কী ভাবে রাখা হবে, তার দেখভাল করতে হবে কী ভাবে, তার জন্য চিকিৎসক নিয়োগ — এটাও রাজ্য সরকারকে করতে হয়। কারও ইচ্ছে হলো, আর কোথাও থেকে উট এনে মানুষের মনোরঞ্জন করার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হলো — আইনত কোনও সুযোগ এক্ষেত্রে নেই।’

    অতএব মা চললেন কৈলাসে। উট চলল রেসকিউ সেন্টারে। পুজো কমিটি উচ্চ আদালতে যাচ্ছে কি?
  • Link to this news (এই সময়)