• ফাঁকিবাজি-কাটমানি থেকে চড়া ভিজিট! প্রশ্নের মুখে সেই ডাক্তাররাই
    প্রতিদিন | ২১ অক্টোবর ২০২৪
  • স্টাফ রিপোর্টার: চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন, ইংরেজি নববর্ষ। বছরের আর পাঁচটা দিনের মতো পশ্চিম বর্ধমানের অন্ডালের খান্দরা গ্রামীণ হাসপাতালের আউটডোরে থিকথিকে ভিড় রোগীদের। কেউ এসেছেন প্রবল জ্বর ও খিঁচুনিতে সংকটাপন্ন শিশুকন‌্যাকে নিয়ে। কেউ পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত, রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর। হাসপাতালের ভিতরে প্রসূতি ওয়ার্ডে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন আসন্ন প্রসবা তরুণী গৃহবধূ। কিন্তু ডিউটিতে থাকা ডাক্তারবাবু বা নার্স দিদিমণিদের পাত্তা নেই। শত খোঁজাখুঁজি করেও তাঁদের দেখা মিলছে না। চরম উৎকণ্ঠা চারদিকে। হতাশ হয়ে বাড়ির পথ ধরেছেন অনেকে। খোঁজ মিলল একটু পরই। জানা গেল, হাসপাতালের ডাক্তারবাবু ও নার্সদিদিরা সকাল থেকে ব্যস্ত রয়েছেন নববর্ষের পিকনিক করতে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তিনতলায় চলছে ভূরিভোজের আয়োজন। মেনুতে বেগুনি, ভাত, ভেজ সবজি, মিক্স মুগডাল, মাছ, মাটন কারি, চাটনি, পাঁপড় ও মিষ্টি। দুপুর দেড়টার পর রীতিমতো কবজি ডুবিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে ঢেকুর তুলতে তুলতে নিচে নেমে অবশেষে কাজে যোগদান।

    পিছিয়ে যাওয়া যাক আরও কয়েক মাস। ২০২৩-এর ২০ নভেম্বরের ঘটনা। সেদিন ছিল রবিবার। স্নায়ুরোগের গুরুতর সমস‌্যা নিয়ে স্থানীয় বি এন বসু হাসপাতালে গিয়েছিলেন খড়দহের আজমতলার বাসিন্দা তনুশোভা ব‌ন্দ্যোপাধ‌্যায়। কিন্তু দেখা গেল সেখানে রবিবার সকালে ডিউটিতে আসেননি ডাক্তারবাবু। তিনি ব‌্যস্ত নিজের প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখতে। সাগর দত্ত ও অন‌্য হাসপাতালে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা! সেদিন ডাক্তার না দেখিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়েছিল তনুশোভাদেবীকে। মুর্শিদাবাদ মেডিক‌্যাল কলেজের এক কর্তা তাঁর ব‌্যক্তিগত চেম্বারে এক মাসে ৪০টি পায়ের অস্ত্রোপচার করেছিলেন। যা নিয়ে অভিযোগ ওঠায় জল গড়ায় স্বাস্থ‌্যভবন পর্যন্ত। এই ঘটনার তদন্তের নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। যদিও তার রিপোর্ট এখনও অজানা।

    ঘটনা এমন অসংখ‌্য! যেগুলি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে আর জি কর কাণ্ডের আবহে স্বাস্থ‌্য ব‌্যবস্থায় অনিয়ম’-এর প্রতিবাদে ক্ষোভে ডাক্তারদের একাংশের পথে বসে থাকার সময়ে। আন্দোলনে রক্ত সঞ্চার করতে যোগ দিয়েছেন বাম ও অতি বাম সমর্থকরা। স্লোগান, রক্ত গরম করা গণসংগীত, পথনাটিকায় কমপ্লিট প‌্যাকেজ। আকাশ বাতাশ জুড়ে বিপ্লব বিপ্লব গন্ধ! আর ‘বিপ্লবের’ এই ঘনঘোর সময়ে গ্রামগঞ্জের মানুষজনের মনে পড়ছে অতীতে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। যেমন মানদহের বৈষ্ণবনগরের বাসিন্দা সেলিলুদ্দিন শেখ। ২০১৭-এর ৫ মার্চ প্রান্তিক কৃষিজীবী মানুষটি ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন মালদহ মেডিক্যাল কলেজে। ভোর রাত থেকে কাউন্টারে লাইন দিয়ে টিকিট কেটে অস্থিবিভাগে যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন সেদিন বিভাগটাই বন্ধ। বাধ্য হয়ে ডাক্তার না দেখিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁকে। একই অভিজ্ঞতা যদুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা আরতি চৌধুরীরও। যাওয়ার আগে বলতে শোনা গেল, ‘‘এভাবে টাকা খরচ করে কতদিন ডাক্তার দেখাতে আসব। গ্রামে ফিরে সেই হাতুড়ের কাছ থেকে ওষুধ নিতে হবে।’’

    সবাই অবশ‌্য ফেরেননি। অনেকেই প্রাইভেট চেম্বারে গিয়ে চড়া ভিজিট দিয়ে হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদেরই দেখিয়ে বাড়ি ফেরেন। বাইরে থেকে চড়া দামে ওষুধ কিনে। শুধু কি ডিউটি ছেড়ে চেম্বার করা? রাজ্যের স্বাস্থ‌্য ব‌্যবস্থার বদল চেয়ে বিপ্লবে শামিল হওয়া ডাক্তারবাবুদের ভিজিটের বিষয়টাও তো উঠে আসে প্রায়শই। বিভিন্ন মেডিক‌্যাল কলেজ থেকে পাস করেছেন এই ডাক্তারবাবুরা। যেখানে পড়ার খরচ অনেক কম। কারণ আমজনতার করের টাকায় সেখানে ডাক্তার তৈরির জন‌্য সাবসিডি দেওয়া হয়ে থাকে। উদ্দেশ‌্য, সুলভ খরচে চিকিৎসার সুযোগ পাবে গ্রাম-গঞ্জের প্রান্তিক মানুষজন। বাস্তব চিত্রটা অবশ‌্য অন‌্য। ৫০০ টাকা ভিজিটের নিচে ডাক্তার পাওয়াই কঠিন। একটু নামী হলেই তাঁর ভিজিট চার অঙ্কে। সেই ১০০০, ২০০০, ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত ভিজিট নেওয়া সেই সিনিয়ার ডাক্তাররাই আজকের জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের মুখ‌্য মদতদাতা, প্রধান সমর্থক, মূল সহায়ক শক্তি। সিনিয়ার ও জুনিয়র চিকিৎসকদের এই যৌথ প্রচেষ্টাতে আপাতত সরকারি হাসপাতালগুলিতে চরম দুর্ভোগের শিকার রোগীরা। প্রাইভেট চেম্বারগুলো অবশ‌্য খোলা।

    সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ডামাডোলে সেই প্রাইভেট চেম্বারের সামনে লম্বা লাইন লম্বাতর হচ্ছে। ঘটি-বাটি বিক্রি করে নিজের বা প্রিয়জনদের চিকিৎসা করাতে বাধ‌্য হচ্ছেন দিন আনি দিন খাই আমজনতা। পরিকল্পনাটি ভারি চমৎকার! সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব‌্যবস্থা নিয়ে ডামাডোল তৈরি করো। নিজেদের চেম্বারে ব‌্যবসা রকেটের মতো উঠবে। মাথায় রাখতে হবে, কোনও সিনিয়র চিকিৎসক কিন্তু একবারও বলছেন না, আন্দোলন চালাকালীন তাঁরা তাঁদের চেম্বারে বিনামূল্যে রোগী দেখবেন! এবং কাটমানি! দীর্ঘদিন মেডিক‌্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের পেশায় চাকরি করে আসা রামকৃষ্ণ স‌ান‌্যালের ভাষায়, সে নাকি ভারি রোমাঞ্চকর কাহিনি! সরকারি হাসপাতালে দুপুরে একটা সময়ের পর রোগীদের প্রবেশ বন্ধ। তখন ওষুধ কোম্পানির এজেন্টদের দেখা করার সময়। চারপাশ থেকে জনা সাতেক রিপ্রেজেন্টেটিভ সমস্বরে নিজেদের প্রোডাক্টের গুণকীর্তন করে চলেছে। ডাক্তারবাবু ব‌্যস্ত ফ্রি স‌্যাম্পেল কালেকশনে। প্রাইভেট চেম্বারেও একই ছবি। এক্ষেত্রে চালু নিয়ম হল, ওষুধ কেনার সময় দোকানে ডাক্তারের নাম বলতে হবে। মাসের শেষে কোন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে কোন কোম্পানির কত টাকার ওষুধ বিক্রি হয়েছে, তার লিস্ট তৈরি হবে। সেই অনুযায়ী কমিশনের খাম পৌঁছে যাবে ডাক্তারবাবুর কাছে। এক্স রে, ইসিজি, রক্ত পরীক্ষা, এমআরআই ইত‌্যাদি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। যত টেস্ট, তত কমিশন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বহুজাতিক ওষুধ সংস্থার পূর্ব ভারতীয় সেলস ম‌্যানেজার যে সব চমকপ্রদ কাহিনি শুনিয়েছেন, তা রীতিমতো শিহরন জাগানো।

    কলকাতার এক নামী লিভার বিশেষজ্ঞ তাঁর বাড়ির গোটা আসবাবপত্র পালটে দেওয়ার ‘নির্দেশ’ দিয়েছিলেন এক ওষুধ কোম্পানিকে। আরেক নামকরা সার্জনকে প্রতি বছর বড়দিনের মরশুমে বাছাই করা বিদেশি ব্র‌্যান্ডের সুরার বোতল বোঝাই লেটেস্ট মডেলের ফ্রিজ দেওয়ার স্ট‌্যাডিং নির্দেশ আছে ওষুধ কোম্পানির কাছে। এছাড়া পুজো-দীপাবলিতে উপহার তো আছেই! এছাড়া বছরে দু’বার ডাক্তারবাবুদের সপরিবার বিদেশ, নিদেন পক্ষে কাশ্মীর বা গোয়া-হিমাচল-দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের যাবতীয় ব‌্যবস্থা করার দায়িত্বও ওষুধ কোম্পানি বা প‌্যাথোলজি, এক্সরে, এমআরআই পরীক্ষাকেন্দ্রগুলির। সেই ব‌্যবস্থার মধ্যে বিমানের টিকিট, হোটেল, গাড়িই শুধু নয়। ফেরার আগে শখের মার্কেটিংয়ের খরচও জোগাতে হয়। তবেই না প্রেসক্রিপশনে থাকবে কোম্পানির ওষুধের নাম বা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে নানবিধ পরীক্ষার নির্দেশ!
  • Link to this news (প্রতিদিন)