• কাটোয়ায় এখনও ঘোড়ার গাড়ি চালিয়েই সংসারের জোয়াল টানেন নবি, নুরাইরা
    বর্তমান | ২২ অক্টোবর ২০২৪
  • সংবাদদাতা, কাটোয়া: কাকভোরে উঠে ঘোড়াকে ছোলা, কুঁড়ো খাওয়াতে খাওয়াতেই জীবনের অর্ধেকটা বছর পেরিয়ে গেল কোহিনূর বিবিদের। কারণ, সকাল হলেই ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে ছুটতে হবে স্বামীদের। গণপরিবহণ হিসেবে ঘোড়ার গাড়ি অচল হলেও এখনও তা বেশ কয়েকটি গ্রামের পরিবারের মুখে দু’ বেলা অন্ন জোগায়। বাজারে নিত্যনতুন মোটরগাড়ির ছড়াছড়ি। কিন্তু বাপ ঠাকুরদার আমলের ঘোড়ার গাড়ি বেচতে মন চায় না নবি, নুরাইদের। এখনও তাঁরা ঘোড়ার গাড়ি ছুটিয়েই সংসারের জোয়াল টানেন। সবার ভরণ পোষণের দ্বায়িত্ব বাঁশের ওই গাড়িটার। তবে এখন ঘোড়ার গাড়িতে কেউ চড়েন না। তাতে খড়, মুদিদ্রব্য, চাল এইসব নিয়ে যাওয়া হয়। পণ্য পরিবহণ করে দিনপিছু কারও আয় হয় ৩০০, কারও ৪০০ টাকা। তাও ওই টাকা পেতে দু’ দিন লেগে যায়। কিন্তু ঘোড়ার গাড়ি চালানো ছাড়া এখন তাঁরা যে ভারী কাজ করতে পারেন না। ‘বাবা ছোটবেলায় শিখিয়েছিলেন, কীভাবে ঘোড়ার মুখে লাগাম পরাতে হয়। কীভাবে ছোলা খাইয়ে ঘোড়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হয়। সেই সময়ে বাবাকে ‘নবাব’ বলে মজা করতাম। আজকে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ছোটবেলার সেই উপহাস আমার নিজেদের অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে বুঝতে পারিনি।’ ঘোড়ার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলছিলেন কাটোয়ার কৈথন গ্রামের বাসিন্দা নরি শেখ। তিনি আরও বলেন, ‘আগে আমার ঘোড়ার গাড়িতে কত লোক চাপত। আজকে রাস্তা দিয়ে গেলে তারাই উপহাস করে বলে, বয়স তো হল এবার লাগাম ছাড়ো।’ নবি বলেন, ‘পেশা ছাড়লে খাব কী?’ তাঁর স্ত্রী আলেমা বিবি বলেন, ‘আমার স্বামীর হাঁপানি রোগ রয়েছে। জীবনের শুরু থেকেই ঘোড়ার গাড়ির আয়েই সংসার চলছে। ছেলেমেয়েদের বড় করেছি। সব শখআহ্লাদ ওই ঘোড়া কেন্দ্রিক। আমাদের জীবনটা ঘোড়ার খুরে গাঁথা হয়ে গিয়েছে। 

    কাটোয়া ১ ব্লকের কৈথন গ্রামে আগে প্রচুর ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া পাওয়া যেত। এখন সাত থেকে আটটি রয়েছে। তবে সেগুলি মূলত খড় বোঝাই করে এ গ্রাম, ও গ্রাম বিক্রি করে বেড়ায়। কাটোয়া মহকুমায় এখনও বেশ কয়েকটি গ্রামে ওই দৃশ্য দেখা যাবে। শহরের রাজপথে টগবগিয়ে এখনও তারা মালপত্র বহন করে। কিন্তু আধুনিক যুগের মানুষগুলোর কাছে জোটে শুধু উপহাস। 

    গবাদি পশু, ছাগল কেনাবেচার হাট রয়েছে। কিন্তু ঘোড়া এখন কোথায় পাওয়া যায়? উত্তরে গ্রামের বাসিন্দারা জানান, এখনও নবাবি মুলুক মুর্শিদাবাদে গেলেই ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকায় দিব্যি মিলে যাবে অল্প বয়সি ঘোড়া। আগে তো পূর্বস্থলীর জামালপুরে বড় ঘোড়ার হাট ছিল। সেদিন আর নেই। কৈথন গ্রামের আরেক বাসিন্দা নুরাই শেখ বলেন, চল্লিশটা বছর পেরিয়ে গেল ঘোড়ার মুখের লাগাম ধরেই। দিনের শেষে ঘোড়ার খোরাক জোগাতে এখনও হিমশিম খেতে হয়। তবে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি ওই ঘোড়ার গাড়ি চালিয়েই। তাঁর স্ত্রী কোহিনূর বিবি বলেন, আমাদের ভাঙা বাড়ির চাল ফুটো। আকাশ দেখা যায়। ভাঙা চালের নীচে শুয়েই স্বপ্ন দেখেছিলাম বাড়িতে ঘোড়া আছে, তাহলে স্বামী নবাব আর আমি তাঁর বেগম। কিন্তু বেগম সাহেবা আর হয়ে ওঠা হল না। ঘোড়ার ওই বাঁশের গাড়িটাতেই আমাদের সংসারের কাহিনি লেখা রয়েছে।-নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)