তিনি রাজ্যের মধ্যে জিআরপি থানার প্রথম মহিলা ওসি। জাঁদরেল পুলিশ অফিসার রূপসিনা পারভিনকে দেখে ঘাবড়ে যায় অতিবড় দুষ্কৃতীও। পেশা জীবনে নজির গড়ার মতোই সবার অলক্ষ্যে ব্যক্তিগত জীবনেও অনন্য একটি কৃতিত্বের অধিকারী রূপসিনা। ৪১ বছর বয়সি রূপসিনা তিন সন্তানের মা। তার মধ্যে দু’টি সন্তানকেই অবিবাহিত অবস্থায় দত্তক নিয়েছিলেন তিনি। সংখ্যালঘু রূপসিনাকেই মা বলে জানে হতদরিদ্র হিন্দু পরিবারের দু’টি ছেলেমেয়ে। নিজের কন্যা রিশোনার সঙ্গেই মাতৃস্নেহে তিনি বড় করছেন দুই ভাইবোন অন্তরা ও অয়নকে।রূপসিনার বাপের বাড়ি বসিরহাটের চারঘাটে। তাঁর বাড়ির পাশেই থাকতেন এক দরিদ্র বাগদি দম্পতি। মাছ ধরে তাঁরা সংসার চালাতেন। দিন আনা দিন খাওয়া দম্পতির এক ছেলে এবং এক মেয়ে। ছেলে অয়ন সাঁতরার বয়স তখন মাত্র সাড়ে চার বছর। অন্তরা সবে জন্মেছে। অভাবের সংসারে দু’টি বাচ্চাকে মানুষ করা অসম্ভব ছিল দম্পতির। প্রথম দিকে তাদের নিজের বাড়িতে এনে খাওয়াতেন রূপসিনা। ক্রমে তাঁর কাছেই থাকতে শুরু করেন অয়ন ও অন্তরা। পরে আইন মোতাবেক বাগদি দম্পতির দু’টি সন্তানকেই দত্তক নেন রূপসিনা। অবিবাহিতা কন্যার সেই সিদ্ধান্তে আপত্তি করেননি পরিবারের লোকজন।
এম-কম পাশ করে রেলের পুলিশ বাহিনী জিআরপিতে চাকরি পান রূপসিনা। চাকরির সূত্রে ভিন জেলায় পোস্টিং হলেও, দুই ছেলেমেয়েকে মানুষ করার ক্ষেত্রে এতটুকু গাফিলতি দেখাননি তিনি। রূপসিনার প্রথম পোস্টিং হয়েছিল হাওড়া জিআরপি থানায় সাব ইনস্পেক্টর পদে। এর পরেই জিআরপি ওসি হয়ে তিনি বদলি হন বনগাঁয়। বনগাঁর পর বারাসত জিআরপি থানারও ওসি হন রূপসিনা। ২০১৪ সালে এলআইসিতে কর্মরত রহিম মণ্ডলের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। বর্তমানে বারাসতের ফ্ল্যাটে স্বামী ও তিন সন্তানকে নিয়ে তাঁর ভরা সংসার।
তাঁর নয় বছরের মেয়ে রিশোনা ক্লাস ফোরে পড়ে। অন্তরা এখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। আর অয়ন বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি অয়ন ভালো ছবিও আঁকেন। ছুটির দিনে তিন ভাইবোন বাবা-মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে রেস্তোরাঁয় যায়। পরিবারে উৎসব হয় পুজোয় আর ইদে। তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে নতুন জামাকাপড় কেনাকাটা, বেড়াতে যাওয়া, বাইরে খেতে নিয়ে যান রূপসিনা এবং রহিম।
রূপসিনার কথায়, ‘অন্তরা ও অয়নের বাবা মায়ের দারিদ্র আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। ওঁদের আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই অন্তরা এবং অয়নকে দত্তক নিয়েছিলাম আইন মেনেই। অবিবাহিত হয়েও লোকে কী বলবে, তার তোয়াক্কা করিনি। এ ক্ষেত্রে আমার পরিবার এবং স্বামী খুব সহযোগিতা করেছেন। নিজের সন্তানের থেকে অয়ন এবং অন্তরাকে কখনও ভিন্ন চোখে দেখিনি।’
কয়েক মাস আগে গণপিটুনির হিড়িকে বিরাটি স্টেশনে মানসিক ভারসাম্যহীন এক মহিলার কোলে শিশু সন্তানকে দেখে ছেলেধরা সন্দেহে তাকে কেড়ে নিয়েছিল উত্তেজিত জনতা। সে সময়ে জিআরপি থানার ওসি রূপসিনার কোলেই আশ্রয় পেয়েছিল শিশুটি। ওই মহিলাই যে শিশুটির মা, সেটি প্রথম থেকেই বলে আসছিলেন তিনি। তাঁর বক্তব্য ছিল, ওই মহিলার প্রতি দুধের শিশুটির ব্যবহারে বোঝা গিয়েছিল তিনি ওর মা। দুঁদে পুলিশ অফিসারের মুখে সে কথা শুনে ভুরু কুঁচকেছিলেন অনেকেই। পরে আদালতেও তাই প্রমাণ হয়। সন্তানের প্রতি মমত্ব থেকেই কি সে দিন সে কথা বুঝেছিলেন তিনি? উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসলেন মা।