• ডাক্তারদের অনশন প্রত্যাহারের পরে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় গ্রুপ ছেড়ে দিচ্ছেন সহ-নাগরিকেরা
    আনন্দবাজার | ২২ অক্টোবর ২০২৪
  • আরজি করের ঘটনার পর থেকেই জেলায় জেলায় মফস্‌সল এলাকায় রাতারাতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ। নির্যাতিতার জন্য বিচারের দাবিতে নাগরিকদের সেই গ্রুপগুলিতেই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছিল স্থানীয় স্তরে মিছিল, মিটিং বা মানববন্ধনের কর্মসূচির। কিন্তু সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের নবান্ন-বৈঠকের পরে ‘আমরণ অনশন’ প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন এলাকায় গ্রুপ ছাড়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সোদপুর থেকে শ্রীরামপুর, হাওড়া থেকে ডানকুনি কিংবা নদিয়ার রানাঘাট— বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে তেমনই ছবি দেখা যাচ্ছে। তবে ভিন্ন উদাহরণও রয়েছে।

    যাঁরা গ্রুপ ‘লেফট’ করে যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই ‘হতাশ’। এমন প্রশ্নও তোলা হচ্ছে যে, এই আন্দোলনের কি আর কোনও ভবিষ্যৎ রইল? তবে অনেকে এ-ও বলছেন যে, ‘মূল দাবি’ আদায় এখনও বাকি। অর্থাৎ, নির্যাতিতার জন্য বিচার। সেই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলেও কেউ কেউ ‘সাহস’ যোগাচ্ছেন। তবে বিভিন্ন এলাকার ‘গ্রুপ অ্যাডমিন’-রা মেনে নিচ্ছেন, ‘আমরণ অনশন’ প্রত্যাহারের পর থেকে অনেকেই তাঁদের কাছে ‘হতাশা’ ব্যক্ত করছেন। অনেকেই গ্রুপ ছেড়ে দিচ্ছেন।

    বস্তুত, নির্যাতিতার বাড়ির এলাকার একটি গ্রুপ থেকে সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ৩০ জনের বেশি ‘লেফট’ করে গিয়েছেন। হুগলির শেওড়াফুলি-বৈদ্যবাটি এলাকাতেও একাধিক গ্রুপ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একই ভাবে হাওড়ার সালকিয়া-বামুনগাছি এলাকার একটি গ্রুপ, রানাঘাটের নাগরিকদের গ্রুপ, শ্রীরামপুর থেকে মধ্যমগ্রাম— বিভিন্ন এলাকায় স্কুলের প্রাক্তনীদের ‘প্রতিবাদী’ গ্রুপ থেকেও ‘লেফট’ হয়েছেন অনেকে। একাধিক গ্রুপে কী কী ঘটেছে, সেই সংক্রান্ত তথ্যও আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে রয়েছে।

    পুজোর আগে থেকেই নাগরিক আন্দোলন খানিক ‘স্তিমিত’ হচ্ছিল। বিভিন্ন গ্রুপে স্থানীয় স্তরে কর্মসূচি গ্রহণে কিছু ‘নিষ্ক্রিয়তা’ দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন, অষ্টমীর রাতে ধর্মতলায় সমাবেশ বা দ্রোহের কার্নিভালের বিভিন্ন ছবি এবং পোস্টার গ্রুপগুলিকে ‘সচল’ রেখেছিল। কিন্তু সোমবার ধর্মতলায় ‘আমরণ অনশন’ প্রত্যাহারের পর অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন, এখানেই আন্দোলন থমকে গেল! তবে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অন্যতম ‘মুখ’ দেবাশিস হালদার মঙ্গলবার বলেছেন, ‘‘আন্দোলন থামার কোনও প্রশ্নই নেই। অনশন তোলা মানে আন্দোলন থেকে সরে আসা নয়। আগামী শনিবার সমাবেশ (গণ কনভেনশন) থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আমরা আন্দোলনকারীরা কোনও হতাশার জায়গায় নেই। কেউই যেন হতাশ না হন।’’

    তবে অ্যাডমিনেরা মানছেন, অনেকের মধ্যেই সাময়িক ভাবে ‘হতাশা’ কাজ করছে। নির্যাতিতার বাড়ির এলাকায় নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সাথী দত্ত বলেন, ‘‘আন্দোলন নানা বাঁক নিয়ে অনশনে এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু অনন্তকাল তো তা চলতে পারে না। অনেকে হয়তো আবেগে গ্রুপ ছাড়ছেন। কিন্তু বাস্তবটাও তাঁদের বুঝতে হবে।’’ তিনি এ-ও বলেন, ‘‘অনেকে গ্রুপ ছাড়লেও গ্রুপে অনেকেই বার্তা দিচ্ছেন, তাঁরা মনে করেন না আন্দোলন শেষ। বিচারের দাবিতে আন্দোলন চলবেই।’’ হুগলির শেওড়াফুলি-বৈদ্যবাটি এলাকার একটি নাগরিক গ্রুপের অ্যাডমিন রাজকুমার দাস বলেন, ‘‘অনশন প্রত্যাহারের ঘোষণার পর থেকে বেশ কয়েক জন গ্রুপ ছেড়েছেন। তবে এটাও ঠিক যে, বেশ কিছু দিন ধরে গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তাও দেখা যাচ্ছিল। যত ক্ষণ না ফের কেন্দ্রীয় ভাবে নতুন আন্দোলনের রূপরেখা জানানো হচ্ছে, তত ক্ষণ নতুন করে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।’’ গড়িয়া এলাকার চারটি স্কুলের প্রাক্তনীদের নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছিল। তারা একাধিক কর্মসূচিও করেছে। সেই গ্রুপের অন্যতম অ্যাডমিন তথা পেশায় নৃত্যশিক্ষিকা বলেন, ‘‘আমাদের গ্রুপের পক্ষ থেকে অনেকেই আমরা অনশনমঞ্চে গিয়ে বেশ কয়েক রাত জেগেছি। অনশন প্রত্যাহারের পরে অনেকেরই মনে হচ্ছে, আর বোধ হয় কিছু হবে না। তবে আমার মনে হয়, এটা সাময়িক।’’ আবার ভিন্ন ছবিও রয়েছে। যেমন হুগলির উত্তরপাড়ার অন্যতম বড় নাগরিক গ্রুপের অ্যাডমিন শাশ্বত মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, অনশন প্রত্যাহারের পরে তেমন কোনও ‘নেতিবাচক’ মনোভাব গ্রুপে দেখা যায়নি। কেউ তাঁদের গ্রুপ ছেড়ে বেরিয়েও যাননি।

    অক্টোবরের শুরু থেকেই আরজি কর নিয়ে সমগ্র আন্দোলন হয়ে গিয়েছিল কলকাতা কেন্দ্রিক। বলা ভাল ধর্মতলার অনশনমঞ্চ কেন্দ্রিক। রাত দখলের ডাক দেওয়া সংগঠকেরাও সে কথা মেনে নিয়েছেন। তবে অনশন প্রত্যাহারের পরের ছবি ভিন্ন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। গ্রুপে কেউ কেউ এমনও মন্তব্য করেছেন যে, ‘জুনিয়র ডাক্তারদের জন্য আর রাস্তায় নেমে আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। একমাত্র বিচারের দাবিতেই আন্দোলন জারি রাখা উচিত’। এটা কি ধৈর্যচ্যুতি? সমাজকর্মী তথা অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষ যেমন বলেছেন, ‘‘আমাদের বুঝতে হবে মূল যে দাবি, নির্যাতিতার জন্য বিচার, তা আদালতে বিচারাধীন। আমাদের দেশের বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা কারও অজানা নয়। অনেকেই হয়তো ভাবছেন খুব দ্রুততার সঙ্গে তাঁরা বিচার পাবেন। তা হচ্ছে না দেখেই হয়তো এই মনোভাব দেখাচ্ছেন।’’ তবে তিনি এ-ও বলেছেন, ‘‘অনশন কত দিন চলতে পারে? জুনিয়র ডাক্তারদের জীবনের বিনিময়ে তো আন্দোলন হতে পারে না!’’ এই বক্তব্য বিভিন্ন গ্রুপেও অনেকে বলছেন। কিন্তু তা দিয়ে গ্রুপ ছেড়ে যাওয়া ঠেকানো যাচ্ছে না। তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী অবশ্য এই প্রবণতাকে রাজনৈতিক ইঙ্গিতে কটাক্ষ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা এই গ্রুপগুলি ছাড়ছেন, তাঁরা সবাই মিলে নতুন একটা গ্রুপ খুলুন— শূন্যের পাশে আমরা সবাই।’’

  • Link to this news (আনন্দবাজার)