সরকারি ভবনই সন্দীপের ‘আমোদ অট্টালিকা’, ঝুলি থেকে বেরচ্ছে আরও বিড়াল!
প্রতিদিন | ২৩ অক্টোবর ২০২৪
ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: সোমবার নবান্নে যখন জুনিয়র ডাক্তাররা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন ঠিক সেই সময় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতির ঝুলি থেকে বেরল আরও এক বিড়াল!। যার নেপথ্যে সেই সন্দীপ ঘোষ ও তাঁর দলদল।
ইন্দিরা মাতৃ সদন। পাইকপাড়ায় আর জি করের অ্য়ানেক্স বিল্ডিং। যেখানে একসময় শিশুরোগ ও মানসিক রোগের আউটডোর ছিল। অভিযোগ, সন্দীপ ঘোষ অধ্যক্ষের চেয়ারে বসার কয়েক বছরের মধ্যে এই বিল্ডিং বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুটি আউটডোরই আর জি করের মূল হাসপাতালে তুলে আনা হয়। তাহলে ইন্দিরা মাতৃ সদন বিল্ডিংটির কী হল?
অভিযোগ, সন্দীপ ঘোষের সাঙ্গপাঙ্গ এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ ডাক্তারি পড়ুয়ারা ‘আমোদ ভবন’ গড়ে তুলেছিল ওই বিল্ডিংয়ে। ‘থ্রেট কালচারে’র বিরুদ্ধে সরব হওয়া জুনিয়র ডাক্তার ও ডাক্তারি পড়ুয়াদের দাবি, সন্দীপ ঘোষের বদান্যতায় তাঁর ঘনিষ্ঠ কিছু ডাক্তার নিজেদের ‘আস্তানা’ গড়ে তুলেছিল সেখানে। জানা গিয়েছে, যে ৫১ জন পড়ুয়াকে আর জি কর কাউন্সিল ‘সাসপেন্ড’ করেছিল, তাদের মধ্য়ে অনেকে এই বিল্ডিংকে হস্টেল হিসেবে ব্যবহার করতেন। পাইকপাড়া থেকে কিছুটা দূরে কে এল এম হস্টেলে এই পড়ুয়াদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু থ্রেট কালচারে অভিযুক্ত পড়ুয়া ও ডাক্তাররা সেখানে থাকতেন না। তার পরেও ইন্দিরা মাতৃ সদন, পুরোদস্তুর সরকারি বিল্ডিংয়ে হস্টেল বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকী, ওই হাসপাতালেরই ক্রিটিকাল কেয়ারের মেডিক্যাল অফিসার ডা. তাপস প্রামানিক যাকে বার বার সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা গিয়েছে, তিনিও জানাচ্ছেন, “আমরা কোনওদিনও ইন্দিরা মাতৃ সদনে যাইনি। আমাদের যেতে ভয় করত।” সূত্রের দাবি, আর জি করের দুঁদে, ডাকসাইটের চিকিৎসকরা ভয়ে কোনওদিন ইন্দিরা মাতৃ সদনে পা রাখতেন না। কিন্তু কেন ভয় করত?
অভিযোগ, ২০২১-২০২২ সালে যারা যারা সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল, মাঝরাতে সেই সমস্ত ডাক্তারি পড়ুয়াকে ললিত মোহন হস্টেল থেকে ওই বিল্ডিংয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হত। ‘সবক’ শেখানো হত। কাউকে দীর্ঘক্ষণ নীলডাউন করিয়ে রাখা হত, তো কাউকে সময় বেঁধে দিয়ে বলা হত বাজার করে আনতে। বাজারের দাম কম-বেশি হলে, অকথ্য অত্যাচার চলত। যা নিয়ে ক্রমেই ক্ষোভ জমছিল। এর মাঝেই ডা. জুনিথ (বর্তমানে ইন্টর্নশিপ করছেন) নামে এক ডাক্তারি ছাত্রকে ফেল করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। যিনি একটি পেপারে ৭২ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন, তাঁকে ফেল করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে সন্দীপ ঘোষ ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে। কারণ, জুনিথ নাকি সন্দীপ ঘোষের হয়ে কাজ করতে রাজি হননি।
‘থ্রেট কালচার’, আর জি করের অরাজকতা নিয়ে জুনিয়র ডাক্তার ও ডাক্তারি পড়ুয়ারা যখন সরব হচ্ছেন ঠিক তখন কলেজ কর্তৃপক্ষ খুঁজে পেল ইন্দিরা সদনের কঙ্কালসার চেহারা। আম জনতার কাছে সুস্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্য প্রশাসন কোটি কোটি টাকা খরচ করছেন। অথচ বিপুল টাকা খরচ করে সাধারণ মানুষের স্বার্থে থাকা একটা সরকারি জমি, সরকারি বিল্ডিং কীভাবে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়, তা দেখিয়ে দিলেন সন্দীপ ঘোষ, এমনই দাবি করছেন আন্দোলনকারীরা। আড়াই তলা, তিনতলা বিল্ডিংয়ের ঘরগুলো কীভাবে হস্টেল হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল তা দেখে স্বাস্থ্যকর্তারা কার্যত হতভম্ব। আর পুরোটাই হয়েছিল সন্দীপ ঘোষের অঙ্গুলিহেলন! সূত্রের খবর, মাঝেমধ্যে সেখানে রাত কাটাতে যেতেন সন্দীপও। বিল্ডিংয়ের বাইরে রাতভর দাঁড়িয়ে থাকত প্রচুর বাইক।
এই বিল্ডিং ইন্দিরা মাতৃ সদনের ভবিষ্যত কী? এই বিল্ডিং ফের পুরনো চেহারায় ফিরে আসবে তো? ফের আমজনতার চিকিৎসার স্বার্থে এটা ব্যবহার করা হবে তো? সব প্রশ্নের উত্তর পেতে স্বাস্থ্যভবন, প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে আর জি কর কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালে পূর্ব ভারতের সেরার সেরা হাসপাতালের তকমা পেয়েছিল আর জি কর। আবার পূর্ব ভারতের একমাত্র যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণকারী হাসপাতাল এই আর জি কর। সেই হৃত গৌরব ফিরে পাবে তো হাসপাতাল, সেই উত্তর পেতে প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।