গঙ্গা ভাঙন পরিযায়ী, মৎস্যজীবী বানিয়েছে সম্পন্ন কৃষিজীবীকেও
বর্তমান | ২৩ অক্টোবর ২০২৪
সৌম্য দে সরকার, মালদহ: ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে ‘গঙ্গা আমার মা...’ গানটি মন ছুঁয়ে গিয়েছিল আপামর বাঙালির। কিন্তু মালদহের গঙ্গা তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের কাছে এই নদী যেন বিভীষিকা। দশকের পর দশক কৃষিজমি,বাস্তুভিটে গিলে খেয়েছে গঙ্গা। সর্বস্ব হারিয়ে সম্পন্ন কৃষিজীবীও পরিণত হয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিক অথবা মৎস্যজীবীতে। তাঁদের জীবনের বারোমাস্যায় আজও প্রতিধ্বনিত হয় গঙ্গা ভাঙনের এক করুণ বাস্তব। প্রায় তিন দশকের এই ভয়াবহ বিপর্যয় অব্যাহত। ভাঙন দুর্গতদের এখন একটাই দাবি-স্থায়ী সমাধান।
ভাঙনের শিকার হয়ে বাড়িঘর হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা আজও কাঁদায় তরিকুল ইসলাম, খিদির বক্স, চিত্ত সরকার, নারায়ণ মণ্ডলদের। গঙ্গা কীভাবে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে, তাঁদের স্মৃতিতে আজও স্পষ্ট। তরিকুল বলেন, আটের দশকের মাঝামাঝি। শুরুটা হয়েছিল কৃষিজমি দিয়ে। আমরা তখন বেশ ছোট। প্রায়শই শুনতে পেতাম গঙ্গায় তলিয়ে গিয়েছে আত্মীয় অথবা চেনাশোনা মানুষদের কৃষিজমি। বালির বস্তা ফেলে ভাঙন প্রতিরোধ করার কিস্সা শুরু তখনই। কিন্তু তাতে হয়নি কিছুই। তলিয়ে গিয়েছে লক্ষ লক্ষ বস্তা। তার চেয়েও বেশি বোল্ডার। কিন্তু গঙ্গা মানব জমিনকে গ্রাস করতে করতে ক্রমশ এগিয়ে এসেছে নতুন নতুন জনপদের দিকে।
খিদির বক্সের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল মালদহের গঙ্গা ভবন তলিয়ে যাওয়ার সেই অসহায় দৃশ্য। তাঁর কথায়, ১৯৯৮ থেকে ভয়াবহ মোড় নিতে শুরু করে গঙ্গা ভাঙন। কৃষিজমি কেড়ে নিয়ে তখন গঙ্গা গ্রাস করতে শুরু করেছে একের পর এক গ্রাম। ২০০৩ সালের আগস্ট মাসের এক দুপুরে মালদহের গঙ্গা ভবন ধীরে ধীরে উদরস্থ করে নদী। অসহায়ের মতো গঙ্গার সেই বিধ্বংসী রূপ দেখেছিলেন জেলা প্রশাসন ও পুলিসের কর্তারা। অন্যদিকে ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্ন শিউরে তুলেছিল পঞ্চানন্দপুরের বাসিন্দাদের। অনেকে তার আগে থেকেই বাড়ি ছাড়তে আরম্ভ করেন। গঙ্গা ভবন তলিয়ে যাওয়ার পরে আর ঝুঁকি নেননি কেউই। একে একে গোলোকটোলা, কামালতিপুর, জানুটোলা, উজিরটোলা, আহ্লাদিটোলা, জাহিরটোলা, হাজারিটোলা, নসরতটোলা, ঘাসিটোলা, মাঝিটোলা, উমেদ হাজি টোলা, নবীটোলা, সাদেক সামশু টোলা গ্রাস করে নেয় গঙ্গা।
তরিকুল, খিদির, চিত্ত, নারায়ণদের স্মৃতিতে আজও ভেসে বেড়ায় ভাঙন পূর্ববর্তী সময়ের দৃশ্য। তাঁরা বলেন, এক সময় ওই সব গ্রামে বাস করতেন সম্পন্ন কৃষকরা। তাঁদের ধানের গোলা, কলাইয়ের গোলা ইত্যাদি থেকে বিবেচনা করা হতো কে কতটা সম্পন্ন। সেসব দেখেই বিয়ের সম্বন্ধ হত। তখন টাকা নয়, উৎপন্ন ফসলই ছিল মানুষের আর্থিক অবস্থা যাচাই করার মাপকাঠি।
গঙ্গার করাল গ্রাসে সেই সম্পন্ন গৃহস্থদের উত্তরসূরীদের অনেকেই আজ দাদন নিয়ে ভিনরাজ্যে যান শ্রমিক হিসাবে। আবার কেউ স্রেফ মাছ ধরে সংসারের বোঝা টেনে চলেছেন।