হুগলির হংসেশ্বরী মন্দির: শান্ত দেবী দক্ষিণাকালী অমাবস্যায় প্রচণ্ডা, প্রতিমা ও দেবস্থান ঘিরে তন্ত্রের গূঢ় রহস্য
বর্তমান | ২৩ অক্টোবর ২০২৪
নিজস্ব প্রতিনিধি, চুঁচুড়া: সারাবছর তিনি দক্ষিণাকালী রূপে পুজো পান। তখন শান্ত চেহারায় বিরাজ করেন। কিন্তু কার্তিক মাসের অমাবস্যার দীপান্বিতা তিথিতে রূপ যায় বদলে। তখন তিনি প্রচণ্ডা। বছরে এই একবারই রূপ বদল করেন হুগলির বাঁশবেড়িয়ার জাগ্রত দেবী হংসেশ্বরী।
তখন মুখে ভয়াল মুখোস আর লকলকে রক্তজিহ্বা ধারণ করেন দেবী। বছরে এই একবারই তন্ত্রমতে তাঁর পুজো। তখন দেবী এলোচুলে প্রচণ্ডা। শুধু রূপ বদলই নয়। দেবীর অবস্থান থেকে গঠনতন্ত্রে, মন্দিরের নির্মাণ পদ্ধতিতে, সবেতেই নানান বৈচিত্র। সঙ্গে চমকে দেওয়ার মতো ইতিহাস। ফলে প্রায় দু’শো বছর পার করেও দেবী হংসেশ্বরীর কাহিনি অমলিন রয়ে গিয়েছে স্মৃতিপটে।
সাবেক বংশবাটি বা গড়বাটিতে দেবী হংসেশ্বরী, মহাদেবের নাভিপদ্ম থেকে উঠে আসা পদ্মের উপরে অবস্থান করেন। তার এক পা ভাঁজ করে পদ্মের উপর রাখা। অন্য পা ঝুলন্ত। দেবীমূর্তি চর্তুভুজা, নীলবর্ণা, নিমকাঠের তৈরি। মহাকাল শিব পাথরে তৈরি। যদিও মন্দিরে চর্তুদশ শিব আছে। এমন ভঙ্গিমা কালীপ্রতিমার ক্ষেত্রে বিরল। এর কারণ খুঁজতে মন্দিরের বৈচিত্রময় গঠনেও নজর দিতে হবে। আর জানতে হবে, এক ‘সন্ন্যাসী রাজা’র সত্যি গল্প।
১৭৯২ সাল। বাঁশবেড়িয়ার রাজা নৃসিংহদেব রায় চলে যান কাশী। সেখানে তিনি তন্ত্রসাধক হয়ে ওঠেন। রাজাই বাঁশবেড়িয়ায় হংসেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় শুরু করেন। মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী শঙ্করীদেবী সেই কাজ শেষ করেন। জনশ্রুতি, সন্ন্যাসী-রাজা নৃসিংহদেব এ সংক্রান্ত স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তখন তন্ত্রমতে কালীপুজো বাংলায় হতোই। নৃসিংহদেব পুজোর পাশাপাশি বিরল এক পদক্ষেপ নিলেন। মন্দিরের নির্মাণ শৈলীতে গেঁথে দিলেন তন্ত্রসাধনার মূল সুর। তান্ত্রিক মতে, ষটচক্রভেদই মোক্ষ লাভের উপায়। মন্দির নির্মাণে সেই তত্ত্বই অনুসরণ করা হয়েছে। মানবদেহের সুষুম্নাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ছয় চক্রের অবস্থান। কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করে সহস্রাধার অর্থাৎ অন্তিম চক্রে যাওয়াই মোক্ষ লাভ। মন্দিরে এই কুলকুণ্ডলিনী চক্রে অবস্থান করছেন স্বয়ং হংসেশ্বরী। সহস্রদল পদ্মের উপর দেবীর অবস্থান। যা চর্যাপদের সাধনতত্ত্বকে স্মরণ করায়। পাঁচ নাড়ির রূপক হিসেবে পাঁচ সিঁড়ি রয়েছে মন্দিরে। যা উপরের দিকে ধাবিত হয়ে আশ্চর্য গোলকধাঁধা তৈরি করেছে। সেটাই অন্তিমচক্র। আর সেখানেই সাদা লিঙ্গের আকারে শিব অধিষ্ঠিত। একটি উপনিষদ মতে, ‘হং’ হচ্ছে বীজস্বরূপ আর ‘সঃ’ শক্তিস্বরূপা, সেটিই হংসেশ্বরী বা পরিশুদ্ধ মোক্ষ। পাঁচতলা মন্দিরে ১৩টি মিনার রয়েছে। প্রতিটি মিনারের চূড়া পদ্মের আদলে নির্মিত। সেখানেও তন্ত্রসাধনার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
একদা বর্ধিষ্ণু জনপদ বাঁশবেড়িয়ার সাবেক গৌরব অস্ত গিয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেই এই বিরল নির্মাণ শৈলী আর বিরল গঠন নিয়ে জাগ্রত মহিমায় বিরাজমান দেবী হংসেশ্বরী।