• প্রশাসন থেকে দল, ‘দানা’র ঝাপটায় এলোমেলো সব সূচি, কলকাতা ও জেলার কোথায় কী কী প্রস্তুতি
    আনন্দবাজার | ২৩ অক্টোবর ২০২৪
  • বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার সকালের মধ্যে তা স্থলভাগে আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ওড়িশার ভিতরকণিকা এবং ধামারের মাঝে ঘূর্ণিঝড়ের ‘ল্যান্ডফল’ হতে পারে বলে জানিয়েছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের উপকূল সংলগ্ন জেলাগুলিতে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি তুঙ্গে প্রশাসনের। দুর্যোগের কারণে প্রশাসন থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একাধিক কর্মসূচি এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। বৃহস্পতিবারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে চার মন্ত্রীকে যোগ দিতে নিষেধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় জোর দিতে বলা হয়েছে। ঝড়ের কারণে বাতিল হয়ে গিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সফরও।

    দুর্যোগের কারণে কলকাতা, হাওড়া-সহ একাধিক পুরসভায় জরুরি বিভাগকে আগেভাগে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। খোলা হয়েছে একাধিক কন্ট্রোল রুম। রাজ্যের চার মন্ত্রীকে ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি তদারকির বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁদের যোগ দিতে নিষেধ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার উপকূল সংলগ্ন এলাকায়। ওই দুই জেলাতেও আলাদা করে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে প্রশাসন।

    আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগর থেকে ক্রমে উত্তর-পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ‘দানা’। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যে তা শক্তি বাড়িয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে। তার পর আরও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আছড়ে পড়বে স্থলভাগে। সেই সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের সর্বোচ্চ গতি থাকতে পারে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। এর ফলে বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ঝড়বৃষ্টি চলবে বাংলার উপকূলে। প্রবল বৃষ্টির লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা এবং ঝাড়গ্রামে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে শুক্রবার পর্যন্ত। এই জেলাগুলিতে জারি করা হয়েছে কমলা সতর্কতা।

    পূর্ব মেদিনীপুরের কিছু এলাকায় বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি হতে পারে ঝড়ের গতি। ওই জেলায় ঝড়ের লাল সতর্কতাও জারি করা হয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় হাওয়ার গতি থাকতে পারে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার থেকে ৯০ কিলোমিটার। ঝাড়গ্রামেও ৮০ কিলোমিটারের বেশি বেগে ঝড় হতে পারে। কলকাতায় হাওয়ার বেগ থাকবে ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার।

    বৃহস্পতিবার বিকেলে নবান্নে মন্ত্রিসভার বৈঠক হওয়ার কথা। দুর্গাপুজোর পর এটাই মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের কারণে রাজ্যের চার মন্ত্রীকে ওই বৈঠকে যোগ না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া, বনমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা, মৎস্যমন্ত্রী বিপ্লব রায়চৌধুরী এবং সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী বঙ্কিমচন্দ্র হাজরাকে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। চারটি পৃথক জায়গায় পাঠিয়ে তাঁদের সেখানকার পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে বলা হয়েছে। মানসকে মেদিনীপুরে, বিরবাহাকে ঝাড়গ্রামে, বিপ্লবকে দিঘায় এবং বঙ্কিমচন্দ্রকে সুন্দরবনে পরিস্থিতির মোকাবিলা করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

    বুধবার দুপুর থেকে শনিবার পর্যন্ত কলকাতা পুরসভায় জরুরি বিভাগে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। নিকাশি, বিদ্যুৎ, আলো, উদ্যান, স্বাস্থ্য, নাগরিক সুরক্ষা এবং জঞ্জাল অপসারণ বিভাগকে বাড়তি সতর্ক থাকতে বলেছেন পুর কর্তৃপক্ষ। খোলা হয়েছে বিশেষ কন্ট্রোল রুম। এই কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে নবান্ন এবং লালবাজারও সংযুক্ত থাকছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কোথাও কোনও বিপত্তি ঘটলে কন্ট্রোল রুমের নম্বরে যোগাযোগ করতে পারবেন সাধারণ মানুষ। পুরসভার কন্ট্রোল রুমের যোগাযোগের নম্বর— ২২৮৬১২১২, ২২৮৬১৩১৩ এবং ২২৮৬১৪১৪।

    বৃষ্টির কারণে শহরে নিকাশি ব্যবস্থায় যাতে খুব বেশি সমস্যা না হয়, আগে থেকে তার জন্য প্রস্তুত পুরসভা। তৈরি রাখা হয়েছে ২৮১টি নিকাশি যন্ত্র। এ ছাড়া, শহরের বিভিন্ন এলাকায় ৪৫২টি পাম্প সক্রিয় রাখা হয়েছে। হাইড্রোলিক ল্যাডার-সহ একাধিক যন্ত্রপাতিও প্রস্তুত রয়েছে। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীও প্রস্তুত রয়েছে শহরে।

    ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবিলার জন্য সমস্ত দফতরের কর্মীদের ছুটি বাতিল করেছে হাওড়া পুরসভা। হাওড়ার মুখ্য পুর প্রশাসক সুজয় চক্রবর্তী জানিয়েছেন, তিনটি বড় পাম্প-সহ ৭০টি পাম্প তৈরি রাখা হয়েছে তাঁর পুরসভায়। এ ছাড়া, জেলার আটটি স্কুলবাড়ি ফাঁকা করে রাখা হয়েছে। ভারী বৃষ্টির কারণে জলমগ্ন এলাকা থেকে স্থানীয়দের সরাতে হলে ওই স্কুলবাড়িতে আশ্রয় নেবেন তাঁরা। মজুত করে রাখা হয়েছে প্রচুর জলের পাউচ এবং শুকনো খাবার। হাওড়া পুরসভার কন্ট্রোল রুমের নম্বর— ৬২৯২২৩২৮৭০।

    ঘূর্ণিঝড় নিয়ে মঙ্গলবার বিদ্যুৎ উন্নয়ন ভবনে বিদ্যুৎ দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক এবং বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা সিইএসসির আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। বিদ্যুৎসচিব শান্তনু বসুও বৈঠকে ছিলেন। আধিকারিকদের সতর্ক থাকতে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন মন্ত্রী। ঝড়ের ফলে কোথাও বিদ্যুৎ পরিষেবা সংক্রান্ত কোনও সমস্যা তৈরি হলে তা দ্রুত স্বাভাবিক করতে হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। জেলাগুলিতেও পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম মজুত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। জেলার বিদ্যুৎ আধিকারিকদের সঙ্গে ভিডিয়ো কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে কথা বলেছেন তিনি।

    ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কোথাও বিদ্যুৎ পরিষেবা সংক্রান্ত সমস্যা হলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা (ডব্লিউবিএসইডিসিএল) এবং সিইএসসির কন্ট্রোল রুমের হেল্পলাইন নম্বরে যোগাযোগ করতে হবে। ডব্লিউবিএসইডিসিএল-এর হেল্পলাইন নম্বর— ৮৯০০৭৯৩৫০৩ এবং ৮৯০০৭৯৩৫০৪। এ ছাড়াও, টোল ফ্রি নম্বর ১৯২২১ এবং হোয়াট্‌সঅ্যাপ নম্বর ৮৪৩৩৭১৯১২১।

    সিইএসসি-র হেল্পলাইন নম্বর— ৩৫০১১৯১২, ৪৪০৩১৯১২, ১৯১২। হোয়াট্‌সঅ্যাপ নম্বর ৭৪৩৯০০১৯১২। বিশেষ হেল্পলাইন নম্বর— ৯৮৩১০৭৯৬৬৬, ৯৮৩১০৮৩৭০০।

    সুন্দরবন পুলিশ জেলার ফ্রেজারগঞ্জ থানায় বুধবার সকাল থেকেই ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার প্রস্তুতি তুঙ্গে। কাঁচা বাড়ি থেকে বাসিন্দাদের পাকা বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। প্রশাসনের তরফে পর্যাপ্ত খাবার, পানীয় জল এবং বিদ্যুতের জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাইকে প্রচার করে বকখালিতে পর্যটকদের সতর্ক করা হচ্ছে। বার্তা দেওয়া হচ্ছে স্থানীয়দের জন্যেও।

    কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার সল্টলেকের পূর্বাঞ্চল সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে বিজেপির সদস্য সংগ্রহ অভিযানের আনুষ্ঠানিক সূচনা হওয়ার কথা ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবের কথা মাথায় রেখে সেই কর্মসূচি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী শনিবার একই জায়গায় কর্মসূচি হওয়ার কথা। শাহের উপস্থিতিতে এই কর্মসূচিতে রাজ্যের সব জেলার নেতৃত্বকেও ডাকা হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানা ছিল না। পরে শাহের সফর বাতিল হয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়ের আবহে। শনিবারে কর্মসূচি হলে শাহ সেখানে থাকবেন কি না, স্পষ্ট নয়। রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, সব কিছু ঠিক থাকলে শাহ আসতেও পারেন। ‘দানা’র প্রভাবে দুর্যোগ হতে পারে এমন সব জায়গার সাংসদ, বিধায়ক, নেতা এবং অন্য জনপ্রতিনিধিদের নিজের নিজের এলাকায় থাকার নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য বিজেপি।

    ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কলকাতায় ফেরি পরিষেবা বন্ধ থাকবে বৃহস্পতিবার থেকে। বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার ফেরি পরিষেবা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। হুগলি, হাওড়া-সহ বিভিন্ন জেলাতে বুধবার বিকেল থেকেই ফেরি পরিষেবা বন্ধ রাখা হচ্ছে।

  • Link to this news (আনন্দবাজার)