কখনও তিনি উপরাষ্ট্রপতিকে সর্বসমক্ষে নকল করেন। কখনও সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উত্তেজিত হয়ে কাচের বোতল ভাঙেন এবং সেই ভাঙা কাচের টুকরোয় নিজেই আহত হন! ক্ষতস্থানে ছ’টি সেলাই এবং এক দিনের জন্য সাসপেনশন নিয়ে দিল্লি থেকে ফিরে আসেন কলকাতায়। কখনও তিনি অভিনেত্রী সোহিনী সরকার এবং সিপিএমের তরুণী নেত্রী দীপ্সিতা ধরকে নিয়ে সরস মন্তব্য করেন (উনি তো নিজেকে সোফিয়া লোরেন ভাবেন)। কখনও নিজের এলাকায় মেলা বা উৎসবে গিয়ে বিনা ভূমিকায় ‘নদিয়া সে দরিয়া’ বা ‘দম মারো দম’ ধরে নেন। কখনও লোকসভায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আসনে গিয়ে সটান বসে পড়েন। আবার কখনও সুর করে ‘চু-কিতকিতকিতকিত’ বলতে থাকেন। বলে যেতেই থাকেন। কখনও দলীয় সতীর্থ তথা অভিনেতা বিধায়ককে সটান প্রচারগাড়ি থেকে নামিয়ে দেন। কারণ, ‘‘গ্রামের মেয়েরা ভাল ভাবে নেবেন না।’’ আবার কখনও রাজনৈতিক আক্রমণ করতে গিয়ে বামফ্রন্টের প্রবীণ নেতা বিমান বসু সীমা ছাড়ালে পরিচিত সাংবাদিককে ফোন করে আবেগতাড়িত গলায় বলেন, ‘‘এটা কি আমার প্রাপ্য ছিল?’’ কেউ বলেন, তিনি দুর্মুখ। কেউ বলেন, তিনি উপকারী বন্ধু।
যে যা-ই বলুন, যেমনই বলুন, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় পরোয়া করেন না। বরং একটি ঘটনায় তাঁকে নিয়ে বিতর্ক থিতিয়ে যেতে না যেতেই নতুন ঘটনা ঘটিয়ে বসেন! যেমন ঘটিয়েছেন সদ্য সদ্য।
গত মঙ্গলবার যৌথ সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উত্তেজিত হয়ে কাচের বোতল ভেঙেছেন। ডান হাতের বুড়ো এবং কড়ে আঙুল ফালাফালা হয়ে গিয়েছে। কমিটি তাঁকে এক দিনের জন্য নিলম্বিত (সাসপেন্ড) করেছে। বৈঠকের ভিতরে কী হয়েছিল, তা নিয়ে কথা বলেননি কল্যাণ। নিয়ম অনুযায়ী তা বলাও যায় না। তবে কমিটির চেয়ারম্যান জগদম্বিকা পাল প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন। যা সম্পূর্ণ বলে ‘অনৈতিক’ বলে তোপ দেগেছেন ডিএমকে সাংসদ এ রাজা। তৃণমূল সংসদীয় দল সূত্রের খবর, কল্যাণের সঙ্গে কমিটির বৈঠকে বিতণ্ডা বেধেছিল তমলুকের বিজেপি সাংসদ তথা প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের (আইনের ময়দানে দু’জনের দ্বৈরথের ইতিহাস রয়েছে)। এক বিরোধী সাংসদের দাবি, চেয়ারম্যান জগদম্বিকা (তাঁর সঙ্গেও কল্যাণের অতীতে অবনিবনার তথ্য রয়েছে) কল্যাণকে থামাতে যতটা ‘কঠোরতা’ দেখান, অভিজিতের ক্ষেত্রে তা করেননি। খানিকটা হতাশ হয়েই কল্যাণ কাচের বোতল আছড়ে ভেঙে ফেলেন। রক্তারক্তি কাণ্ড!
রুদ্ররসের মতো হাস্যরসও আছে অবশ্য। গত শীতকালীন অধিবেশনে রাজ্যসভা থেকে বিরোধীদের ১৪০ জন সাংসদকে বহিষ্কার করেছিলেন উচ্চকক্ষের চেয়ারম্যান তথা দেশের উপরাষ্ট্রপতি ধনখড়। তার পরে নতুন সংসদ ভবনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দুলে দুলে ধনখড়কে নকল করেন কল্যাণ। তাঁকে ঘিরে যে ভিড় হো-হো করে হাসছিল, তার অংশ ছিলেন রাহুল গান্ধীও। শুধু কি হাসি, কল্যাণের নকলনবিশির ভিডিয়ো নিজের মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে রেখেছিলেন রাহুল। কিন্তু এই কাণ্ডকারখানা কি সাংসদ হিসেবে তিনি করতে পারেন? এগুলো কি তাঁর পদের গরিমা লঘু করে না? পেশায় আইনজীবী কল্যাণের সওয়াল, ‘‘নকলনবিশি একটা শিল্প। এটা প্রথমে স্বীকার করতে হবে। আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আমার সাংবিধানিক অধিকার।’’ পাল্টা প্রশ্নও করেন, ‘‘কোনও শিল্প কি কখনও কোনও কিছুকে লঘু করে?’’
লোকসভার অন্দরে ‘চু-কিতকিত’ও কি কাউকে লঘু করে? বা চপলমতি বলে প্রমাণ করে? গত বাজেট অধিবেশনের সময় কল্যাণের সেই ‘কীর্তি’ তৃণমূলে অক্ষয় হয়ে আছে। অধিবেশনে কেন্দ্রীয় সরকারকে কড়া আক্রমণ করে বক্তৃতা করেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, মহুয়া মৈত্রেরা। কিন্তু কল্যাণের ‘চু-কিতকিত’ খেলা সকলকে ছাপিয়ে গিয়ে শিরোনাম হয়ে গিয়েছিল। দলের অন্দরের খবর, কোনও কোনও নেতা ওই চাপল্যে খানিক ‘বিরক্ত’ হয়েই নেত্রীকে বলেছিলেন, কল্যাণকে লোকসভার মুখ্য সচেতকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। মমতা মানতে চাননি।
অষ্টাদশ লোকসভায় বিজেপি একক গরিষ্ঠতা পায়নি। সংসদের প্রথম অধিবেশনে তাঁর প্রথম বক্তৃতায় কল্যাণ বক্তৃতা করতে গিয়ে বিজেপিকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘‘বলেছিল, এ বার ৪০০ পার! খেলা শুরু হয়ে গিয়েছিল। খেলা তো অনেক রকম হয়। চু কিতকিতটাও একটা খেলা। চু কিতকিতে চু ধরা ছিল ৪০০তে। তার পর কিতকিতকিতকিতকিতকিতকিতকিতকিত...কত হল? ২৪০!’’ কেন বলেছিলেন? কল্যাণের সহজ জবাব, ‘‘অত বড় একটা বিষয়কে একটা সাধারণ কথা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম!’’
সংসদে তাঁর এমন সমস্ত ভূমিকার জন্য কখনও তাঁকে বকাঝকা করেননি মমতা? কল্যাণের জবাব, ‘‘না। কখনওই না! দিদি প্রশংসাই করেছেন। অভিষেকও প্রশংসা করেছে।’’
২০০৯ সালে শ্রীরামপুর লোকসভায় দাঁড়িয়ে প্রথম জিতেছিলেন। তার পর থেকে পরের পর ভোটে কল্যাণ ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়েছেন। ২০১৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপি যখন প্রার্থী করেছিল বাপ্পি লাহিড়িকে, তখন যে কল্যাণ একটু ‘উদ্বিগ্ন’ হননি, তা নয়। কিন্তু তাঁকে ‘দাবায়ে’ রাখা যায়নি।
গত লোকসভায় কল্যাণের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন তাঁরই প্রাক্তন জামাতা কবীরশঙ্কর বসু। তবে প্রাক্তন শ্বশুর তাঁকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। বরং গোটা ভোটে কল্যাণের সঙ্গে ‘দ্বৈরথ’ চলেছিল সিপিএমের দীপ্সিতার। একটা সময়ে কল্যাণের ব্যবহার নিয়ে শ্রীরামপুরের রাজনীতিতে কম আলোচনা ছিল না। তৃণমূলের অনেক নেতাই একান্ত আলোচনায় তাঁর ব্যবহার নিয়ে অনুযোগ করতেন। তবে গত ১৩ বছর ধরে কল্যাণকে দেখে বুঝে গিয়েছেন, তিনি এমনই। এখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বলেন, ‘‘কল্যাণদার মেজাজ চেরাপুঞ্জির মতো। এই রোদ। এই বৃষ্টি।’’
কল্যাণকে ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন ভোট ময়দানে তাঁর তরুণী প্রতিদ্বন্দ্বী দীপ্সিতা। মন্দ বলেননি। ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের একটি মফস্সল শহরকেন্দ্রিক এলাকার জনপ্রতিনিধি হয়েও সাতষট্টি বছরের কল্যাণ সারা দেশে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। বোতল-ভাঙা কাণ্ডে তাঁর খোঁজ করছে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমও। ‘মুড’ ভাল থাকলে সম্ভবত মমতাও মেনে নেবেন যে, এতটা রং মদন মিত্রও জমাতে পারেননি!