সৌম্যদীপ ঘোষ, সিউড়ি: হেমন্তের সূর্য তখনও পুব আকাশে উঠেনি। খঞ্জনি বাজিয়ে হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন গ্রামের রাস্তায় গান গেয়ে চলেছেন প্রায় নবতিপর এক বৃদ্ধ। ঠান্ডা এখনও সেভাবে পড়েনি। কার্তিকের সামান্য শীতল হাওয়া। সেটা গায়ে মেখেই সুরেলা আওয়াজ ছড়িয়ে দিচ্ছেন পথে-প্রান্তরে। হাঁটছেন তিনি। পায়ে চপ্পল। গলায় কণ্ঠির মালা। পরণে ঝকঝকে পাঞ্জাবি। ভোরের আলো ফোটার আগেই তিনি চক্কর কেটে ফেলেছেন তিন-চারটে পাড়া। তাঁর টহল গানে কেউ জাগছেন। কেউ আবার একটু জেগে বিড়বিড় করে রতনবাবুর নাম নিয়ে চাদরে মুখ গুঁজছেন। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। তিনি রতন কাহার। মাত্র ক’মাস আগেই দিল্লিতে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে নিয়েছেন পদ্মসম্মান-স্মারক। কিন্তু, কোনও সম্মান, পুরস্কারই তাঁর দৈনন্দিন জীবনে বৈচিত্র্য আনতে পারেনি। ফলে, এই হেমন্তে বীরভূমের রত্ন রতনবাবুর রোজনামচায় কোনও অদলবদল ঘটেনি।
দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে গোটা কার্তিক মাস জুড়ে সিউড়ির অলিগলিতে প্রভাতী গান গেয়ে বেড়ান ‘বড় লোকের বিটি লো…’ গানের স্রষ্ঠা। স্থানীয় ভাষায় যাকে ‘টহল’ বলে। সম্পূর্ণ রাঢ় বঙ্গীয় মৌলিক ঘরানার প্রভাতী গান। এখন নেটফ্লিক্স যুগে সবাই ব্যস্ত। ঘড়ির কাঁটা মেপে চলা নাগরিক জীবন। বাংলার টহল গান প্রায় বিস্মৃত। কিন্তু সিউড়ির ঘুমভাঙানিয়া প্রভাতী সঙ্গীত ও রতনবাবুর নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত হয় আজও। সিউড়ির ভোরের নিদ্রাভঙ্গের দায়িত্ব নিজেই তুলে নিয়েছিলেন তিনি। প্রতিবছর কার্তিক মাস পড়লেই ভোর ৩ টে থেকে খঞ্জনি নিয়ে বৈষ্ণবী ও কবিগান গাইতে বেরিয়ে পড়েন তিনি। আগে খালি পায়েই গায়ে একটা চাদর চড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতেন। এবছর তাঁর হাতে উঠেছে পদ্মসম্মান। বয়সও হয়েছে বেশ। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তবেই যেতে পারেন কোনও অনুষ্ঠানে। দেখার ছিল, এবার রতনবাবু আদৌ ভোরে বের হন কি না!
ওই যে বাংলাতে বলে, ‘না মরলে, থামবে না জীবন’। এটাই রতনবাবুর দর্শন। তাই থেমে নেই তিনি। কার্তিক পড়তেই পাড়ায় পাড়ায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছেন। গান গাইছেন। তবে, বয়সের ভারে এখন আর অনেক এলাকাতেই পৌঁছতে পারেন না। বাড়ুইপাড়া, মালিপাড়া থেকেই ঘুরে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। বাংলার লোক গানের সংস্কৃতি এভাবেই আজও ধরে রেখেছেন রতনবাবু।
পথ চলতে চলতে তিনি বলছিলেন, ‘তখন আমি খুব ছোট। ভোরে বাড়ির পাশ দিয়ে কাউকে গান গেয়ে যেতে শুনেছি। আমাদের ঘুম ভাঙত এই গান শুনেই। ঠাকুরের নাম শুনেই সকলে ঘুম থেকে উঠতাম। বড় হয়ে আমিও একইভাবে টহল দেওয়া শুরু করি। কোনও বছরই বাদ দিইনি। এবারই বা কেন বাদ দেব? তাই বেরিয়ে পড়েছি। এর মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ খুঁজে পাই।’
রতনবাবুর ছেলে শিবনাথ কাহারের কথায়, ‘বাবা তো এবারও প্রতিদিন বেরোচ্ছে। ৩৫ বছর ধরে এভাবেই রাস্তায় রাস্তায় ঠাকুর, দেবতার গানে টহল দেয় বাবা। মাসের শেষে গৃহস্থ থেকে চাল, পয়সা—যে যা কিছু দেন, তাই নিয়ে আসে। ১১ পৌষ বাড়িতে খাওয়ানো হয়। গ্রামের লোকেরা খাওয়া-দাওয়া করেন। বাবার বয়স হচ্ছে, কতদিন টানতে পারবে, তা জানি না।’ নিজস্ব চিত্র