সৌম্য দে সরকার, মালদহ: প্রকৃতির সঙ্গে অসম লড়াইয়ে বারবার হার মেনেছে মানুষ! গঙ্গার ভাঙন মালদহের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষকে যাযাবর করছে বছরের পর বছর। মাথার ছাদ খুইয়ে কার্যত নিঃস্ব হয়ে পড়া দুর্গতরা সরে গিয়েও থিতু হতে পারেননি। বাস্তুহারা জীবনে আবারও নেমে এসেছে গঙ্গার অভিশাপ। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছেন সর্বহারা অগণিত বাসিন্দা। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন আমবাগানে, আবার অন্য কোথাও উঁচু জায়গায় ডেরা বেঁধেছেন অনেকে। কিন্তু আতঙ্ক পিছু ছাড়েনি গঙ্গা ভাঙনের শিকার ওই অসহায় পরিবারগুলিকে।
ভয়াবহ বিপর্যয় একেবারে সামনে থেকে দেখেছেন এক সময় পঞ্চানন্দপুরের বাসিন্দা তোরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, নদীর তীরে বসতি তৈরি করতে বারণ করেন প্রবীণরা। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল নদী থেকে অনেকটাই দূরে। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছে গঙ্গা। এক সময় দেখেছি আমাদের বাড়ির শুধু রান্নাঘর অবশিষ্ট রয়েছে। পরে তলিয়ে গিয়েছে সেটিও। ভিটের ওপর দিয়ে এখন বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা। পরে বাড়ি সরিয়ে নিয়েছি বেশ কিছূটা দূরে। কিন্তু সেখানেও হানা দিয়েছে নদী। এই অভিজ্ঞতা আমার মতো অনেকের।
কালিয়াচক-২ ব্লকের কামালতিপুরের বাসিন্দারা এক সময় গঙ্গা ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন মানিকচক ব্লকে। নতুন বাসস্থানের নামও তাঁরা রেখেছিলেন কামালতিপুর। কিন্তু প্রকৃতির অদ্ভূত খেয়াল! নতুন কামালতিপুরও এখন প্রহর গুনছে গঙ্গায় সলিল সমাধির।
ইংলিশবাজার শহরের বাসিন্দা গৃহবধূ রুমাশ্রী মণ্ডলের কথায়, আমার মা, বাবা থাকেন রতুয়া-১ ব্লকের মহানন্দাটোলায়। ছোটবেলায় গঙ্গা ছিল আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে। আজও মনে পড়ে আমরা গাড়ি ভাড়া করে গঙ্গাস্নান করতে যেতাম। আচমকাই ভাঙনের তীব্রতা বাড়তে শুরু করল। ক্রমশ বাড়ির দিকে ধেয়ে আসতে থাকল গঙ্গা। ভয়ে বাড়িঘর সরানো হল আরও বেশ কিছুটা দূরে। কিন্তু তাতেও নিস্তার মেলেনি। এই মুহূর্তে আমাদের পৈতৃক ভিটের মাত্র কয়েক মিটার দূর দিয়ে বইছে নদী। আমরা আতঙ্কে রয়েছি যে কোনও মুহূর্তে দ্বিতীয় বারের জন্য ভিটেহারা হতে হবে মা, বাবাকে। আতঙ্কের প্রহর গুনছেন তাঁরাও।
কালিয়াচক-৩ ব্লকের বীরনগরের বাসিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহম্মদ জিয়াউল হকও দীর্ঘদিন দেখছেন ভাঙন পীড়িতদের অসহায়তা। তিনি বললেন, গঙ্গার গ্রাস থেকে বাঁচতে অনেকেই সরে গিয়েছেন। কিন্তু ঠিক পিছু নিয়েছে গঙ্গা। আবারও কেড়ে নিয়েছে কোনওমতে তৈরি করা মাথা গোঁজার ছাদটুকু। এ যেন গঙ্গার সঙ্গে মানুষের অসম প্রতিযোগিতা। কিন্তু এই নদীর কাছে বারবার হার স্বীকার করতে হয়েছে মানুষকে।
যাঁদের সামর্থ্য রয়েছে, মোটা টাকা দিয়ে জায়গা কিনে চলে গিয়েছেন অনেক দূরে। কিন্তু যাঁরা তা পারেননি, আজও দিন কাটাচ্ছেন ভাঙনের সমন মাথায় নিয়ে। ফাইল চিত্র।