কৃষ্ণকুমার দাস: হাই কোর্ট ৫৩ জন জুনিয়র ডাক্তারের বিরুদ্ধে সাসপেনশন ও বহিষ্কারের সমস্ত নির্দেশ খারিজ করে দিয়েছে। তার পরও পরিকল্পিতভাবে আর জি কর হাসপাতালে বিশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে ‘আরডিএ’। শুধু তাই নয়, যাঁরা স্বাস্থ্য পরিষেবায় যোগ দিয়ে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা দিতে চাইছে তাঁদের হুমকি ও চাপ দিয়ে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন অনিকেত-কিঞ্জলরা! এমনই একগুচ্ছ অভিযোগ জানিয়ে বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যভবনে স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগমকে ডেপুটেশন দিলেন আদালতের রায়ে জয়ী হওয়া জুনিয়র ডাক্তাররা।
তাঁদের অভিযোগ, ‘‘সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা বেহাল করে দেওয়ার টার্গেট নিয়ে রাজ্য সরকার বিরোধী রাজনীতি করতে আমাদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে ওরা। প্রবল চাপে পড়ে ওদের সঙ্গে থাকতে বাধ্য হওয়া বহু জুনিয়র ডাক্তার কোর্টের রায়ের পরে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। কিন্তু তাঁদেরও পরিকল্পিতভাবে নানা পন্থা অবলম্বন করে হুমকি দিচ্ছে অনিকেত মাহাতোর দলবল। বলা হচ্ছে, হাই কোর্ট নয়, স্বাস্থ্যভবন থেকে অর্ডার নিয়ে এসো, তবে তোমাদের কাজ করতে দেবো। সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা দিতে এসে হুমকির মুখে পড়ে আমরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি। যাঁরা সরকারি চিকিৎসা না করে, মাস শেষে বেতনের টাকা নিতে চায় তাঁরাই আরডিএ-এর হয়ে হুমকি দিচ্ছেন।’’
সূত্রের খবর, ডেপুটেশন দিতে যাওয়া দশ জুনিয়র ডাক্তারকে স্বাস্থ্যসচিব জানিয়েছেন, ‘‘হাই কোর্টের নির্দেশের অর্থই হল, আর জি করের প্রিন্সিপাল এই সংক্রান্ত যতগুলি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন তার সবগুলি বাতিল হল। আর যে বা যাঁরা হাইকোর্টের এই নির্দেশ কার্যকর করতে বাধা দেবে, তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা কার্যকর হবে।’’ স্বাস্থ্যভবন সূত্রে জানা গিয়েছে, হাই কোর্টের রায় কার্যকর করতে ইতিমধ্যে আর জি করের প্রিন্সিপালকে প্রয়োজনীয় কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদিন ডেপুটেশনের পর, স্বাস্থ্যভবনে তলব করা হয় আর জি করের মেডিক্যাল সুপার সপ্তর্ষি চট্টোপাধ্যায়কেও। প্রিন্সিপাল ও সুপার যৌথভাবে তদন্ত কমিটির নামে আরডিএ-র কথায় রাজ্য সরকারের সমর্থক ৫৩ জন জুনিয়র চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ খাঁড়া করে শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন বলে স্বাস্থ্যভবনে নথি জমা পড়েছে।
সহকর্মী এক তরুণী চিকিৎসককে নির্মম খুন ও ধর্ষণের ঘটনার আবেগকে হাতিয়ার করে বাম ও অতিবাম রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগসাজশ করে পরিকল্পিতভাবে আর জি করে ক্ষমতা দখলে নেমেছে ‘আরডিএ।’ যদিও রেসিডেন্ট ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন (আরডিএ) নামের এই তথাকথিত সংগঠনের কোনও রেজিস্ট্রেশন বা প্রশাসনিক স্বীকৃতিও নেই। কিন্তু এখন ফের আন্দোলনের নাম করে দু-একটি কর্মসূচি নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে অনিকেত-কিঞ্জলরা। সূত্রের খবর, আগামী শনিবার ফের একটি গণ কনভেশনের ডাক দিয়েছে আরডিএ। এমন কর্মসূচি নেওয়ার নেপথ্যে রয়েছে আন্দোলনের নামে দেশ-বিদেশ থেকে যে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে তার হিসাব না দেওয়ার পরিকল্পিত ছক।
স্বাস্থ্যভবনে ডেপুটেশন দিয়ে বাইরে এসে জুনিয়র ডাক্তাররা এদিন এমনই অভিযোগ করেন। প্রতিনিধি দলের তরফে ডা. অতনু বিশ্বাস ও ডাঃ শিরিস চক্রবর্তী অভিযোগ করেন, ‘‘অভয়া দিদির বর্বরোচিত খুনের পর আমরাই প্রথম ন্যায়বিচার চেয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলাম। দাবি মেনে সিবিআই হল, চার্জশিটও কোর্টে জমা পড়েছে। কিন্তু এখন আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে তথ্য প্রমাণ ছাড়া ক্যাঙারু কোর্টে বিচারের নামে প্রহসন করে শাস্তি দেওয়া হল। আমাদের কলেজ থেকে বের করে দেওয়ার নেপথ্যের মূল টার্গেট হল মেডিক্যাল কলেজে ক্ষমতা দখল করে মৌরসিপাট্টা কায়েম করা। অভয়া-সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে অধিকাংশ সিনিয়র- জুনিয়র ডাক্তারদের হুমকি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে অনিকেত-কিঞ্জলরা। অথচ এখন আর একবারও অভয়ার নাম এরা মুখে আনছে না। সেদিন নবান্নের বৈঠকে একজনও ভুল করেও অভয়া দিদির নাম উচ্চারণ করেনি, শুধুই নিজেরা কিভাবে কোন কমিটিতে ঢুকতে পারবে তাই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সওয়াল করে গিয়েছে।’’
অনিকেত-কিঞ্জলদের এই সরকার বিরোধী ‘পরিকল্পিত থ্রেটকালচার’-এর বিরুদ্ধে পাল্টা কনভেনশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সাসপেনশন স্থগিত হয়ে যাওয়া জুনিয়র ডাক্তাররা। বাম ও অতিবাম রাজনৈতিক নেতৃত্বের যৌথ যড়যন্ত্রের প্ল্যাটফর্ম এই আরডিএ-এর মঞ্চের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা ৫৩ জুনিয়র চিকিৎসকের সঙ্গে ইতিমধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছে অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার-পড়ুয়ারা। সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা অচল করার চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ, বর্ধমান-বাঁকুড়া-মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র চিকিৎসকরা আর জি করের অতনু-শিরিসদের সঙ্গে রীতিমতো ভিডিও কনফারেন্স করে বৈঠক করেছেন। এদিন ডেপুটেশন শেষে ৫৩ জন জুনিয়র ডাক্তারই এক সুরে বলেছেন, ”আমরা সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা শুধু স্বাভাবিক নয়, উন্নততর করতে চাই। বন্যা দুর্গত এলাকায় গিয়ে সরকারি পরিষেবা পৌঁছে দিতে চাই। আর জি কর-সহ সমস্ত মেডিক্যাল কলেজে অন্য সকলের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে চাই। চাপে পড়ে এখন যাঁরা আরডিএ-এর খাতায় নাম লিখিয়েছেন, তাদের সঙ্গেও কাজ করতে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। তারাও তো আমাদের সহকর্মী। এতদিন তো একসঙ্গেই কাজ করেছি। অনিকেত-দেবাশিসরা এসে এই বিভেদ তৈরি করে থ্রেট কালচারের নামে হাসপাতালে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পিত চক্রান্ত করেছে।” এমনই অভিযোগ করেন স্বাস্থ্যভবনে ডেপুটেশন দিতে আসা জুনিয়র চিকিৎসকরা।
অভিযোগ, বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে রাজ্য সরকারের সমর্থকদের বয়কট করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। এক জুনিয়র চিকিৎসকের কথায়, ”আমরা যাঁরা সরকারি পরিষেবায় যুক্ত হয়ে চিকিৎসা দিচ্ছি তাদের সঙ্গে যেন অন্যরা কেউ কাজ না করেন। যাঁরা রোগীর জন্য আমাদের নিয়ে কাজ করবে, তাঁদেরও একই হাল করা হবে।” স্বাস্থ্যসচিব সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখার পাশাপাশি ৫৩ জন চিকিৎসককে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন বলে দাবি জুনিয়র চিকিৎসকদের।