• অকালেই বড় হয়েছে শিশু, কিশোররা, পরিবার, সমাজ ভেঙে টুকরো টুকরো ভাঙনে
    বর্তমান | ২৫ অক্টোবর ২০২৪
  • সৌম্য দে সরকার, মালদহ: এক সময় বাড়ি থেকে অনেকটা হেঁটে এসে গঙ্গায় হুটোপাটি করে ছেলেবেলা কাটাতেন নবিটোলার বাসিন্দা এনামুল হক, মারফত শেখরা। গঙ্গা যেন তখন তাঁদের খেলাধুলোর সঙ্গী। লেখাপড়া করে আর পাঁচজন সমবয়সীর মতোই নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ছিল এই কিশোরদের। কিন্তু ছেলেবেলার খেলার সঙ্গী গঙ্গা এক সময় হয়ে উঠল বিধ্বংসী। কেড়ে নিল এনামুল, মারফতদের কৃষিজমি, বাড়ির উঠোন থেকে শোওয়ার ঘর। আস্তে আস্তে গঙ্গা গ্রাস করল পুরোটাই। তলিয়ে গেল তাঁদের সাধের বিদ্যালয়টিও। চরম আর্থিক অসঙ্গতি কৈশোরেই তাঁদের এবং ওই এলাকার আরও অনেক কিশোরকে বাধ্য করল পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য উপার্জনের রাস্তায় হাঁটতে। তলিয়ে গেল স্কুল, থমকে গেল শিক্ষা। অকালেই বড় হয়ে গেল এনামুল, মারফতরা।

    গঙ্গা গিলেছে বিঘার পর বিঘা কৃষিজমি, গ্রাস করেছে বাস্তুভিটে। তেমনই নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শুধু কী তাই! বাজার, হাসপাতাল কিছুই রক্ষা পায়নি গঙ্গার এই ভাঙন থেকে।

    বুকে আক্ষেপ চেপে অনেকেই জানান, গঙ্গা ভাঙন কেড়ে নিয়েছে অনেক শিশু কিশোর, কিশোরীর শিক্ষার অধিকার। ভাঙনে ভেঙেছে পরিবার, সমাজ আত্মীয়তাও। 

    গঙ্গা ভাঙনের অভিঘাতের জ্বলন্ত প্রমাণ তোরিকুল ইসলাম। তাঁর কথায়, গঙ্গা একের পর এক কেড়ে নিয়েছে অনেকগুলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৪টি উচ্চ এবং প্রায় ৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ধীরে ধীরে চলে গিয়েছে গঙ্গাগর্ভে। ফলে অনেক শিশু, কিশোরের সাধ থাকলেও এগিয়ে যেতে পারেনি লেখাপড়ার পথে। পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কৈশোরেই তাদের নামতে হয়েছে জীবনযুদ্ধে। অনেক নাবালিকাকে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে। 

    কালিয়াচক-৩ ব্লকেও রয়েছে এমন অনেক শিশু, কিশোর। ভাঙনে চুরমার হয়ে যাওয়া বীরনগর-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের চীনাবাজারের বাসিন্দা রাজু শেখের আক্ষেপ, ছেলে রামিম এখন ৮ বছর বয়সেই রাজমিস্ত্রির জোগানদার। ৬ বছরের মেয়ে রিফানাও আর স্কুলে যায় না। ওই এলাকার সাদেক শেখের ছেলে ১৪ বছরের রহিম অথবা মোরসেলিম শেখের তিন ছেলে এখন স্কুলে না গিয়ে সাতসকালে বেরিয়ে পড়ে রোজগার করতে।

    কথায় বলে, নদীর এ কূল ভাঙে, ও কূল গড়ে। গঙ্গা ভাঙন নিয়ে রীতিমতো বিশ্লেষণ করে চলা মোসারেকুল আনোয়ার বলেন, মালদহের ৭৬টি মৌজা একের পর এক চলে গিয়েছে গঙ্গায়। পরে অবশ্য জেগে উঠেছে ২৯টি চর। তার মধ্যে কালিয়াচক-২ ব্লকের ১৬টি এবং মানিকচক ব্লকের ৫টি চরে এখন ঝাড়খণ্ড প্রশাসনের অধিকার কায়েম রয়েছে। ফলে অজান্তেই এক সময় মালদহের অনেক বাসিন্দার রাজ্য বদলে গিয়েছে। তাঁদের সঙ্গে যৌথ পরিবারে দিনরাত কাটানো সদস্যরা ছিটকে গিয়েছেন অন্যত্র। ভাঙন টুকরো টুকরো করেছে আত্মীয়তাকেও। এক সময় মন্দির, মসজিদ, বাজার চত্বরে জড়ো হয়ে নিজেদের সুখ দুঃখের বারোমাস্যা আলোচনা করা মানুষগুলোকেও এখানে ওখানে নিয়ে ফেলেছে ভাঙন। 

    দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাই বৈষ্ণবনগরের বাসিন্দা জিয়াউল হকের মুখ থেকে উঠে আসে, গঙ্গা ভাঙনের আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম! - ফাইল চিত্র।
  • Link to this news (বর্তমান)