• হারানো জমি জেগেছে চর হয়ে, বাসিন্দাদের যন্ত্রণার সাক্ষীও গঙ্গা
    বর্তমান | ২৬ অক্টোবর ২০২৪
  • সৌম্য দে সরকার, মালদহ: গঙ্গা ভাঙন যে শুধু বাড়িঘর, জমি, শিক্ষাঙ্গন কেড়েছে তাই নয়। এক অদ্ভুত দোটানায় ফেলেছে নিদেন পক্ষে আড়াই লক্ষ মানুষকেও। বংশ পরম্পরায় মালদহের ওই বাসিন্দাদের এখন পরিচয় চরবাসী হিসাবেই। গঙ্গা যে জমি কেড়ে নিয়েছিল সেই জমিই প্রকৃতির নিয়মে জেগে উঠেছে আবার। সেই জমিতেই পিতৃপুরুষের ভিটে আগলে আবার নতুন বসতি গড়েছেন ওই মানুষগুলো। কিন্তু কখন যেন তৈরি হয়েছে ঠিকানার এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। 

    তাঁরা মনেপ্রাণে বাংলার হলেও তাঁদের মেনে চলতে হয় ঝাড়খণ্ডের নিয়মকানুন। বুকে একরাশ ব্যথা চেপে আজও দিন কাটান ভাঙনে এক সময় বাস্তুহারা আজকের চরবাসীরা। তবে এই যন্ত্রণার অন্যদিকও রয়েছে। যাঁরা জমিভিটে হারিয়েও রয়ে গিয়েছেন এপারেই তাঁরা চরের বুকে জেগে ওঠা নিজেদের উর্বর জমিতে ফসল উৎপাদন করতে পারেন না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। নদীর ভাঙন যেন এক রকম জোর করেই কেড়ে নিয়েছে তাঁদের বৈধ মালিকানা। 

    গঙ্গা ভাঙনে সর্বহারা মানুষদের জন্য এখনও সরব হন কিছু সংবেদনশীল মালদহবাসী। কথা বলেন তাঁদের হয়ে। এমনই এক নাগরিক মোসারেকুল আনোয়ার বলেন, গঙ্গার ভাঙনে মালদহের যে মৌজাগুলি তলিয়ে গিয়েছিল তার মধ্যে পরে জেগে ওঠা ২১টি মৌজার বাসিন্দারা এখন কার্যত ‘নেই রাজ্যের বাসিন্দা’। তিনি বলেন, ওই চরে বাস করেন প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ। তাঁদের পূর্বপুরুষ এমনকী তাঁরাও কেউ কেউ ১৯৭১ সাল পর্যন্তও এই বাংলারই বাসিন্দা ছিলেন। ভোটও দিতেন এ রাজ্যেই। কিন্তু আজ তাঁরা বাস করেন কার্যত এক দুর্বিষহ অবস্থায়। তাঁদের চরে হাতেগোনা কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও নেই উচ্চ বিদ্যালয়। কলেজ তো দূর! নেই যথাযথ স্বাস্থ্য পরিষেবাও। বাধ্য হয়ে তাঁদের অন্তরের বাঙালিয়ানা জীবন্ত থাকলেও প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ডের নিয়মে চলতে হয় তাঁদের। বাংলায় ফিরতে, পূর্বপুরুষের সংস্কৃতির আবহে নিজেদের আবারও জাগিয়ে তুলতে আকুতি রয়েছে চরবাসীদের। কিন্তু কেই বা ভাবছে ওই মানুষগুলির কথা! মহম্মদ এরফান আলি (৫২), তজবুল হক (৫৩), সেরাজুল শেখ (৬০) মোস্তাক শেখ (৭০), বাদশু শেখ (৬২) সহ অনেক চরবাসীদের কথায় তাঁরা আদ্যন্ত বাঙালি। কিন্তু দশচক্রে যেমন ভগবান ভূত তেমনই ভাঙন বদলে দিয়েছে তাঁদের সাকিন। মনে মনে তাঁদের বাসনা ‘আমার এই বাংলায় জন্ম যেন এই বাংলায় মরি’। গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটির অন্যতম কর্মকর্তা তোরিকুল ইসলামও জানালেন, কীভাবে এক অদ্ভুত টানাপোড়েন গ্রাস করে রেখেছে গঙ্গা ভাঙনের শিকার এই অসহায় মানুষগুলোকে।

    অন্যদিকে রতুয়ার জঞ্জালিটোলার বাসিন্দা রোহিনী মণ্ডল পেশায় কৃষিজীবী। তিনি বলেন, জমি গঙ্গা কেড়ে নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু আবার ফেরতও দিয়েছে চরে। কিন্তু আমরা আর ফেরত পাইনি ফসল উৎপাদনের অধিকার। কখনও নদী পেরিয়ে চরের জমিতে ফসল ফলাতে গেলে হুমকি আসে প্রাণে মেরে ফেলার। একই কথা বললেন আরেক কৃষিজীবী অসীম কুমার মণ্ডলও। তাঁর গলাতেও ঝড়ে পড়ে গঙ্গা ভাঙনে হারিয়ে ফেলা তিন ফসলি জমিতে মনের আনন্দে ফসল চাষ করতে না পারার এক তীব্র যন্ত্রণা। গঙ্গা তার বিস্তীর্ণ দুই তীরের লক্ষ মানুষের এমনই অনেক যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে তবু বয়েই চলেছে! 
  • Link to this news (বর্তমান)