সৌম্য দে সরকার, মালদহ: প্রায় আড়াই দশক নদী ভাঙন অব্যাহত মালদহে। ভাঙন কি আদৌ রোখা যাবে? নাকি এই অভিশাপের পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকবে? আশ্চর্যের বিষয় হল, এই ভাঙনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে গঙ্গার নাম জড়িয়ে থাকলেও বিপর্যয়ের জন্য এই নদীকে সরাসরি দাবি করেন না অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, গঙ্গা চলেছে নিজস্ব গতিতে। ফরাক্কা ব্যারেজের মাধ্যমে বাঁধার চেষ্টার কারণেই বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে গঙ্গা। পাশাপাশি গঙ্গা ভাঙন রোধে সদিচ্ছার প্রসঙ্গে রাজ্য এবং কেন্দ্রের সমর্থকদের দাবি, পাল্টা দাবি অনেক সময়ই পিছনে ঠেলে দিয়েছে হতভাগ্য ভাঙন দুর্গতদের মূল সমস্যা সমাধানের বিষয়টিকে। তাই আজও অব্যাহত মালদহের ভাঙনের শিকারদের হাহাকার।
গত শতকের সাতের দশকে তৈরি হয়েছিল ফরাক্কা ব্যারেজ। অনেকের দাবি, গঙ্গার ভাঙন ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে তারপর থেকেই। ফরাক্কা ব্যারেজ বিলোপের মাধ্যমেই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব বলে মনে করছেন তাঁরা। আবার এমন অভিযোগও ওঠে, ভাঙন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব ব্যারেজ কর্তৃপক্ষেরই। কিন্তু তারা সদিচ্ছা দেখায় না। এনিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনও হয়েছে একাধিকবার।
অন্যদিকে, পাল্টা আঙুল তোলা হয়েছে সেচ দপ্তরের দিকেও। গঙ্গা ভাঙন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত করলেও সেচ দপ্তর সেই বোল্ডার বা বালির বস্তা ফেলে প্রতিরোধের পুরনো কায়দা ধরে রেখেছে বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
এমনই টানাপোড়েনের মধ্যে ভাঙনে সব হারানো মানুষ আজও উত্তর খুঁজে ফেরেন এই বিপর্যয় প্রতিরোধের প্রশ্নে। উঠে আসে বিভিন্ন বিকল্প উপায়ের কথাও।
গঙ্গা ভাঙন নিয়ে নিরন্তর বিশ্লেষণ করে চলা মোসারেকুল আনোয়ার বলেন, ফরাক্কা ব্যারেজকে দায়ী করা হলেও এই প্রকল্পের অবলুপ্তি করা হবে কিনা, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। তবে গঙ্গার তিনটি শাখা নদী ভাগিরথী, পাগলা এবং কালিন্দ্রীর মুখ খুলে দেওয়া হলে গঙ্গা পরিবাহিত জলের অনেকটাই বহন করতে পারবে ওই নদীগুলি। সেক্ষেত্রে ভাঙনের দাপট কিছুটা কমবে বলে আমাদের ধারণা। এছাড়াও জিও সিন্থেটিক ব্যাগ ব্যবহারের মাধ্যমে ভাঙন প্রতিরোধ সম্ভব কিছু ক্ষেত্রে। তবে, সেসবের আগে সদিচ্ছা প্রয়োজন।
গঙ্গা ভাঙন নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন কলেজ শিক্ষক ঋষি ঘোষের বক্তব্য, গত ৫০ বছরে ভাঙন সংক্রান্ত গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় অপ্রচলিত ধারায় এবং সুলভে ভাঙন রোধের বিকল্প ব্যবস্থা খোঁজা। ভিটিভার ঘাস, ফ্লাই অ্যাশ অথবা স্থলভাগের ঢাল উঁচু করে ভাঙন রোধ করা সম্ভব।
তবে সামাল দেওয়ার পদ্ধতি কী হবে সেই বিতর্কে সরাসরি না ঢুকে গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটির কর্মকর্তা খিদির বক্স, তরিকুল ইসলামদের বক্তব্য খুব স্পষ্ট। তাঁরা বলেন, গঙ্গা জাতীয় নদী। সুতরাং গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়া উচিত কেন্দ্রের। অন্যদিকে, রাজ্য সরকার থাকুক ভাঙন দুর্গতদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়িত্বে। কাজের এই সুষ্ঠু ও স্পষ্ট বণ্টনই ভাঙন প্রতিরোধ ও দুর্গতদের সমস্যার সমাধান সফলভাবে করতে পারে। সব পরামর্শ, দাবি এবং মতামতের পরেও গঙ্গা ভাঙন নিয়ে মালদহের বাসিন্দাদের সুর মোটামুটি এক, জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে ঘোষণা করা হোক প্রকৃতির এই অভিশাপকে। (ফরাক্কা ব্যারেজ। - নিজস্ব চিত্র।)