• 'মরে যাবি! তোরা কাছে আসিস না', বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েও বলেছিল সৌরভ
    এই সময় | ২৭ অক্টোবর ২০২৪
  • এই সময়: বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জলের মধ্যে পড়ে ছটফট করছেন বছর ২৫-এর যুবক সৌরভ কুমার গুপ্তা। তাঁকে বাঁচাতে ছুটে গিয়েছেন আরও দুজন। কিন্তু সেই অবস্থাতেও সাহায্যকারীদের ফিরিয়ে দিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী সৌরভ বলছেন, ‘তোরা কাছে আসিস না, মরে যাবি!’ স্রেফ দুটি লাইন, এরপর আর এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেখাননি কেউ। মিনিট দশেক পরে শেষ পর্যন্ত সকলের চোখের সামনে মৃত্যু হয় অসহায় কলেজ পড়ুয়ার। শুক্রবার সন্ধ্যায় এমনই মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী থাকলেন দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরের ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা।দানার জেরে শুক্রবার বিকেলে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে শহরে। ঠিক সে সময়ে হোটেল থেকে খেয়ে ফিরছিলেন সৌরভ। একটি বহুতল আবাসনের লোহার রেলিং-এ হাত লেগে যায় আচমকা। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ছিটকে রাস্তার জমা জলে পড়ে যান তিনি। চিৎকার শুনে তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে যান স্থানীয় দুই যুবক। কিন্তু তাঁর মতো পরিণতি যাতে কারও না হয়, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও সে সম্পর্কে সাবধান করে দিয়ে যান তিনি। সৌরভকে বাঁচাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় যুবক নিখিল প্রসাদ।

    শনিবার তিনি বলেন, ‘চিৎকার শুনে আমি বাঁচাতে যাচ্ছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম সাপে কামড়েছে। একদম কাছে চলে যাওয়ার পরে আমাকে যেতে বারণ করল। হয়ত ভেবেছিল ওকে স্পর্শ করলে আমাদেরও একই অবস্থা হবে। আমরা তখন প্রাণপণে সিকিউরিটি গার্ডকে ডাকতে থাকি। কিন্তু, কেউ কিছু করল না। চোখের সামনে একজনের মৃত্যু দেখলাম। মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। ’

    এই ঘটনায় পুরসভা নিজেদের দায় এড়ালেও পুলিশ একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করেছে। উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে বাড়ি সৌরভের। সেখানকার একটি কলেজে বিএ দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন তিনি। ভবানীপুরে জাস্টিস দ্বারকানাথ রোডে তাঁর বাবার একটি ভুজিয়ার দোকান রয়েছে। মাস দুয়েক ধরে বাবার শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায়, কলকাতায় চলে আসেন ছেলে। বাবাকে পাঠিয়ে দেন প্রয়াগরাজের বাড়িতে। কলকাতায় দোকান চালানোর পাশাপাশি সৌরভ সেখানেই ঘুমোতেন।

    শুক্রবার বিকেল চারটে নাগাদ তিনি যখন খেতে গিয়েছিলেন, সে সময়ে তুমুল বৃষ্টিতে ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের ওই পুরো এলাকা জলে ডুবে গিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, বিকেল পাঁচটা নাগাদ ফুটপাত ধরে হেঁটে আসছিলেন ওই যুবক। দোকান লাগোয়া একটি বহুতলের বাউন্ডারির লোহার রেলিং-এ হাত দিতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। তাঁকে জলের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখে দুই যুবক এগিয়েও গিয়েছিলেন। সৌরভই চিৎকার করে তাঁদের বারণ করেন। ততক্ষণে বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ করতে নিরাপত্তারক্ষীকে নির্দেশ দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

    অভিযোগ, সে সময়ে সিকিউরিটি বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। মেন সুইচ কোথায় বলতে পারব না।’ এ ভাবে প্রায় মিনিট পনেরো সময় নষ্ট হয়ে যায়। তার খেসারত দিতে হয় সৌরভকে। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, ‘বহুতলের বাউন্ডারিতে এক চিকিৎসকের চেম্বারের ঠিকানা দেওয়া বোর্ড লাগানো ছিল। ঘাতক তারটি সেই মিটার বক্স থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আর তা থেকেই শর্ট শার্কিট হয়।’

    সৌরভের দাদা নিশীথকুমার গুপ্তার অভিযোগ, ‘ডাক্তারের বোর্ডে বিদ্যুতের কানেকশন ছিল। ঘটনার পরে কেউ সাহায্য করেনি। নিরাপত্তা কর্মী কোথায় মেন সুইচ, তা-ও বলতে পারেনি। আমরা থানায় অভিযোগ করেছি। ভাইয়ের মৃত্যুর বিচার চাই।’

    শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থলে হাজির হন সিইএসসি-র কর্মীরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘হুকিং ছিল না। তবে মিটার থেকে তার টেনে কানেকশন দেওয়া হয়েছিল। সিইএসসি-র সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট আমরা থানায় জমা দেব।’

    কী বলছেন বহুতলের নিরাপত্তা রক্ষী স্বপন পাল? তাঁর দাবি, ‘আমি নতুন এসেছি। মেন সুইচ কোথায় জানতাম না। তবে, মিনিট দশেকের মধ্যে সুইচ বন্ধ করা হয়। পরে সিইএসসি এসে লাইন কেটে দেয়।’

    এই ঘটনায় পুরসভার দিকেও অভিযোগের আঙুল উঠেছে। কলকাতা পুরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভবানীপুরের একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে। নিশ্চয়ই জল জমেছিল। আমার অত্যন্ত খারাপ লাগছে যে, একটা ছেলে মারা গিয়েছে। গতকাল যেহেতু অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ছিল, তাই বাতির স্তম্ভের আলো বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। যদি বাতি স্তম্ভ খোলা থাকত, তাহলে আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত।’ একই সুর মেয়র পারিষদ (আলো) সন্দীপ বক্সীর গলাতেও। তিনি বলেন, ‘আমরা যেটুকু খবর পেয়েছি, সিইএসসি-র একটি মিটার থেকে বেআইনি ভাবে লাইন টানা হয়েছিল। ওই লোহার গ্রিলের সঙ্গে একটি ঠেলা গাড়ি লোহার শিকল দিয়ে বাঁধা ছিল। সেখান থেকে তার বেরিয়ে এসেছিল। তাতেই শর্ট সার্কিট হয়ে এই ঘটনা ঘটে। পুরসভার এখানে কোনও দোষ নেই।’
  • Link to this news (এই সময়)