• বেলপাহাড়ীর গুহায় লুকিয়ে তাম্রযুগের ইতিহাস, সংরক্ষণের অভাবে নষ্টের মুখে
    বর্তমান | ২৭ অক্টোবর ২০২৪
  • প্রদীপ্ত দত্ত, ঝাড়গ্রাম: বেলপাহাড়ীর পাহাড়, অরণ্যে লুকিয়ে আছে প্রস্তর-তাম্রযুগের ইতিহাস। সংরক্ষণের অভাবে সেই ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে। তামাজুড়ি একসময় তাম্র নিষ্কাশনের মূল কেন্দ্র ছিল। তামাজুড়ির নিষ্কাশিত তামা ও তাম্রজাত পণ্য তাম্রলিপ্ত বন্দর দিয়ে সরবরাহ করা হতো। তামাজুড়ির নব্য প্রস্তর ও তাম্র সভ্যতার ইতিহাসের শুলুক সন্ধানের দাবি তুলছেন ইতিহাসবিদ থেকে গবেষকরা।

    বেলপাহাড়ী শুধু অরণ্য, পাহাড় ঝর্না নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেই সমৃদ্ধ নয়। এখানে লুকিয়ে আছে লুপ্ত সভ্যতার এক ইতিহাস। বেলপাহাড়ী এলাকায় সিংলহর, দেওপাহাড় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দেওপাহাড়ের উপরে আদিম মানুষের গুহার সন্ধান মিলেছে। গুহার দেয়ালে রং-বেরঙের নানা ছবি আঁকা আছে। আলতামিরার গুহার চিত্রের মতোই যার গুরুত্ব। বেশিরভাগ ছবি নষ্ট হয়ে গেলেও গাই গোরুর রঙিন ছবি এখনও টিকে আছে। রাজ্যের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই গুহার ভিতরে অনুসন্ধান চালায়। তিরের ফলা, ত্রিভুজাকৃতি পাথরের চপার, লাঙলের সঙ্গেই তামার কুঠারের সন্ধান মেলে। পাহাড়ের পাদদেশে তামা নিষ্কাশনের চুল্লির সন্ধান মিলেছে। অনুসন্ধান ও সংরক্ষণের অভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্ৰীগুলি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাস বলছে, জেলার দক্ষিণ অংশ লাগোয়া রাঢ়বঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় একসময় জৈন ধর্মের প্রসার ঘটেছিল। স্থানীয় ব্যবসায়িদের বড় অংশ জৈন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তামাজুড়ি, তামাঘুন খনি থেকে তামার আকরিক সংগ্ৰহ করে সড়ক ও জলপথে তৈলকম্প বা তেলকূপি বন্দরে পাঠানো হতো। পুরুলিয়া জেলার তেলকূপি সেকালের বৃহত্তম নৌবন্দর ছিল। সেখান থেকে তামা পৌঁছত তাম্রলিপ্ত বন্দরে। তৈলকম্প চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়কালেই সম্ভবত কর প্রদানকারী সামন্ত রাজ্য ছিল। সন্ধাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ কাব্যেও এই এলাকার উল্লেখ আছে। ইতিহাস ও গবেষকদের মতে নবপ্রস্তর যুগ পেরিয়ে এই এলাকায় তাম্রযুগের বিস্তার ঘটেছিল। মৌর্য সময়কালে এই এলাকা উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে সেই সভ্যতার পতন ঘটে। তাম্রলিপ্ত বন্দরে ব্যবসা বাণিজ্যের হ্রাস হলে তামার খনির গুরুত্ব হ্রাস পায় বলে মনে করা হয়। যার জেরে ধীরে ধীরে প্রাচীন এই সভ্যতার পতন ঘটে। আঞ্চলিক গবেষক ডঃ মধুপ দে বলেন, রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৬০ সালে এই এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে নব্য ও তাম্র প্রস্তর যুগের বহু প্রত্ন সামগ্ৰীর সন্ধান পায়। তামা নিষ্কাশনের চুল্লির সন্ধান পাওয়া যায়। আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও তামা নিষ্কাশনের চুল্লিগুলির অস্তিত্ব ছিল। খননকার্য হলে প্রাচীন ইতিহাসের দরজা খুলে যাবে। সুবর্ণরেখা মহা বিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান লক্ষ্মীন্দর পালুই বলেন, বেলপাহাড়ীতে নব্য প্রস্তর ও তাম্রযুগের বহু প্রত্ন সামগ্ৰীর নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। তাম্রলিপ্ত বন্দরে ব্যবসা বাণিজ্য হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তামাজুড়ির গুরুত্ব কমে যায়। পরবর্তীকালে এখানে লোহা নিষ্কাশনও শুরু হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের সময়ে চিচিড়া এলাকায় লৌহা নিষ্কাশন হতো। হাতিবাড়ি এলাকায় লৌহ নিষ্কাশনের চুল্লি পাওয়া গিয়েছে। বাংলার নবাবরাও এলাকার কারিগরদের লোহার অস্ত্র তৈরির কাজে লাগিয়েছিল। লোহা নিষ্কাশনের জন্য কারখানা পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছিল। তার নিদর্শন পর্যন্ত আছে। রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এখান প্রত্নতত্ত্ব সামগ্ৰী সংগ্রহের কাজ করেছিল। তারপর আর কোনও বড় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ব্যক্তিগত স্তরে প্রত্নতত্ত্ব সামগ্ৰী সংগ্ৰহ ও খনন কাজ কিছু হয়েছে। তবে তা উল্লেখযোগ্য নয়। সংরক্ষণের অভাবে বহু মূল্যবান প্রত্নসামগ্ৰী হারিয়ে যাচ্ছে। ঠিকভাবে খননকার্য করা হলে প্রাচীন এক সভ্যতার সন্ধান পাওয়া যাবে। 
  • Link to this news (বর্তমান)