আমডাঙার করুণাময়ী কালী মন্দিরের সঙ্গে মিশে মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস
বর্তমান | ২৭ অক্টোবর ২০২৪
নিজস্ব প্রতিনিধি, বারাসত: বারাসত শহর লাগোয়া আমডাঙার করুণাময়ী কালী মন্দিরের খ্যাতি দেশজোড়া। আনুমানিক ৫০০ বছরের এই পুরনো মন্দিরকে নিয়ে রয়েছে পুরাণকথা। আমডাঙার নামকরণ থেকে কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা— দুইয়ের পিছনেই রয়েছে মানসিংহের সময়কালের ইতিহাস।
কথিত আছে, দিল্লির সিংহাসনে তখন মোগল সম্রাট হুমায়ুনের পুত্র আকবর। সিংহাসন লাভ করার পরেই তিনি মন দেন সাম্রাজ্য বিস্তারে। ভারতের বাইরেও সাম্রাজ্য বিস্তার ছিল তার লক্ষ্য। পুবের প্রদেশ বাংলাকে ‘টার্গেট’ করেন তিনি। সেই সময় বাংলায় শাসনের দায়িত্বে ছিলেন জমিদাররা। যারা ‘বারো ভুঁইয়া’ নামে খ্যাত। রাজা প্রতাপাদিত্যের নেতৃত্বে বারো ভুঁইয়া রাজত্ব সামলাচ্ছিল যশোরে। তাঁর আরাধ্য দেবী ছিলেন যশোরেশ্বরী। তাঁকে বশে আনতে ও সাম্রাজ্য বাড়াতে সম্রাট আকবর তাঁর সেনাপতি সেলিমকে পাঠিয়েছিলেন যশোরে। বিশাল সেনা নিয়ে তিনি প্রতাপাদিত্যের যশোর আক্রমণ করেন। অসীম সাহসী প্রতাপাদিত্য মা যশোরেশ্বরীর আশীর্বাদী ফুল ও সীমিত সৈন্য নিয়ে মোগল বাহিনীর আক্রমণের মোকাবিলা করেন। সেই যুদ্ধে পরাজিত হন মোগলদের দূত যুবরাজ সেলিম। দিল্লি ফিরে সেলিম জানিয়েছিলেন, বাংলার প্রতাপাদিত্য যশোরেশ্বরী মায়ের পুজো করেই শক্তি অর্জন করেছেন। তা শুনে বিচলিত হয়ে পড়েন আকবর। তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখতে যশোরে পাঠান অম্বরের রাজা মানসিংহকে। তিনি মা যশোরেশ্বরীর বিগ্রহ চুরি করে নিজের শিবিরে নিয়ে আসেন। পরে সেই বিগ্রহ মানসিংহ নিয়ে গিয়েছিলেন অম্বরে। অম্বর প্রাসাদেই অধিষ্ঠিত করেছিলেন মায়ের বিগ্রহকে। যশোর থেকে এক ব্রাহ্মণকেও দেবীর নিত্যপুজোর জন্য রাজস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এদিকে, মা যশোরেশ্বরীর বিগ্রহ না থাকায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন প্রতাপাদিত্য। মায়ের প্রধান সেবায়ত রামানন্দ গিরি গোস্বামী বিগ্রহ চুরির পর পাগলের মতো বাংলায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন। মানসিংহ এই সুযোগে প্রতাপাদিত্যের উপর সেনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরাজিত হন প্রতাপাদিত্য। পরবর্তীকালে মানসিংহ স্বপ্নাদেশ পান। তাতে বিকল্প একটি মূর্তি স্থাপনের নির্দেশ পান তিনি। শেষমেশ অনেক ঘুরে তিনি রামডাঙার জঙ্গলে রামানন্দ গিরির সন্ধান পান। কথিত আছে, রামানন্দের রাম এবং এলাকাটি নদীর ধারে বলে একসময়ে নাম ছিল রামডাঙা। সেই রামডাঙাই মুখে মুখে আমডাঙা নামে পরিচিত হয়। এখানেই আনুমানিক ৫০০ বছর আগে করুণাময়ী কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিদিন প্রচুর ভক্ত এখানে পুজো দিতে আসেন। মানত করে অনেক ভক্ত সোনা এবং রুপোর গয়না দেন মাকে। অনেকে এখানে এসে বিয়ে থেকে অন্নপ্রাশনের উপাচারও সারেন। ভিন রাজ্য থেকেও অনেকে আসেন মন্দিরে পুজো দিতে। প্রতি বছর কালীপুজোয় মন্দিরে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়।
করুণাময়ী মায়ের মন্দিরে বিশেষ স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম রত্নবেদি। ভারতে একমাত্র শ্রীক্ষেত্র ছাড়া আর কোনও তীর্থক্ষেত্রে এই রত্নবেদি নেই। এই বেদির মহাত্ম্য হল ১০৮ টি নারায়ণ শীলা এই বেদির উপরেই প্রতিষ্ঠিত। কথিত আছে, রত্নবেদির আকর্ষণে মহাসাধক রামপ্রসাদ ও পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণদেবের আগমন ঘটেছিল এই মন্দিরে। এছাড়া পঞ্চমুণ্ডীর আসনও এই মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ। তন্ত্রসাধকরা এই আসনে বসেই তপস্যা করেন। এছাড়াও রয়েছে মনসা বেদি, ব্রজমোহন মন্দির। মন্দির কমিটির অন্যতম সদস্য জ্যোতির্ময় দত্ত বলেন, পুজোর কয়েকটি দিন এই মন্দির মহামিলন ক্ষেত্র হয়। এখানে গোঁড়ামির কোনও জায়গা নেই।