এই সময়, কোচবিহার: ‘কাককু এ দিকে এসো’। কে বলল রে! ঘাড় ঘুরিয়ে বোঝার আগেই আওয়াজ উঠল, তফাত যাও, ‘গো ব্যাক, গো ব্যাক’। দেদার আওয়াজ দিচ্ছে মিঠু আর বিঠু, জোড়া ময়না। না, দাঁড়ে বসা নয়, রসিকবিলের পাখিদের এনক্লোজারের নতুন সদস্য ওরা। তারা নিয়ম করে মানুষের বুলি বলছে। ওদের সামনে কেউ দাঁড়ালেই সটান কৈফিয়ত চাইছে , ‘তুমি কে?’ তখন একজন উত্তর দিচ্ছে, ‘আমি মিঠু’। সঙ্গে সঙ্গেই আর একজন বলে উঠছে ‘আমি বিঠু’। এখানেই শেষ নয়, কিছুক্ষণ পরপরই তারা দাবি তুলছে ‘কাককু খেতে দাও।’ খাবার পেলেই কৃতজ্ঞতা ‘কাককু খাওয়া শেষ।’ এই জোড়া ময়নাতেই আপাতত মজে কোচবিহারের তুফানগঞ্জের রসিকবিল পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে আসা পর্যটকরা।কোচবিহার শহর থেকে উদ্ধার হয়েছিল মিঠু আর বিঠু। বন দপ্তর তাদের রেখেছে রসিকবিল-এর এনক্লোজ়ারে। খোলামেলা নিঝুম পরিবেশ। সামনে বিশাল জলাভূমি। জীববৈচিত্রের এক টুকরো স্বর্গে রীতিমতো সেলিব্রিটি মিঠু আর বিঠু। পাখিদের অবাধ ঠিকানা কোচবিহারের এই রসিকবিল। পানকৌড়ি, বিভিন্ন জাতের স্টর্ক, মাছরাঙা, রাঙ্গামুড়ি, ছোট সরালরা সারা বছর লুকোচুরি খেলে ঝিলের কচুরিপানার ফাঁকে। তবে এনক্লোজারের অতিথিরাও কম যায় না৷ এনক্লোজারে আগে আসা ময়ূর, গোল্ডেন ফিজ্যান্ট, বাজরিগার থাকলেও ‘সিনিয়র’দের ছাপিয়ে গিয়েছে দুই নবাগত৷ খাবারের দাবি উঠলেই ফলের প্লেট নিয়ে ছুটছেন বনকর্মীরা৷ পাখি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন চার জন বনকর্মী। তাঁদের কথায়, ‘ময়না দুটো আপেল, পেয়ারা খেতে খুব ভালোবাসে। খাবার দিতে দেরি হলেই ওরা বলতে শুরু করে, ‘খিদে পেয়েছে। খেতে দে।’
শনিবার বিকেলে পাঁচ বছরের মেয়ে প্রকৃতিকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন রাতুল বিশ্বাস। তাঁর কথায়, ‘মেয়ে তো ময়নার খাঁচার সামনে থেকে যেতেই চাইছে না৷ উল্টে বায়না ধরেছে, ময়না দু’টোকে বাড়ি নিয়ে যাবে৷ তা তো সম্ভব নয়।’ তাঁর সংযোজন, ‘এনক্লোজারের সামনে মেয়ে দাঁড়াতেই একজন বলে উঠল, এসো, গল্প করি। অন্য জন বলল, আমার নাম মিঠু, তোমার নাম কী? মেয়ে তো হেসেই লুটোপুটি। এ বার দেখছি, ওই ময়নার টানেই বার বার ছুটে আসতে হবে রসিকবিলে৷’
বন দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, মাস তিনেক আগে কোচবিহার শহরে অভিযান চালিয়ে ২৩টি টিয়া ও এক জোড়া ময়না পাখি উদ্ধার করেন বনকর্মীরা। মাস দেড়েক ধরে পর্যবেক্ষণ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরে তাদের রাখা হয় রসিকবিল পর্যটন কেন্দ্রের এনক্লোজ়ারে। এর আগে বাংলাদেশে পাচার হওয়ার সময়ে উদ্ধার হওয়া একাধিক ম্যাকাও নিয়ে আসা হয়েছিল এখানে। তবে তাদের ছাপিয়ে গিয়েছে নতুন দুই অতিথি। দর্শকরা তার সামনে এলেই হলো! খোশ মেজাজে গল্প শুরু করছে তারা। এক জায়গায় বসার ফুরসত নেই। এই গাছের ডালের দোলনায় তো কিছুক্ষণ পরে খাবার টেবিলে। বন দপ্তরের অনুমান, ময়না দু’টি যে বাড়িতে ছিল কথা বলার অভ্যাসও হয়েছিল সেই সময়ে। সেখানেই তাদের নামকরণ। কোচবিহার বন বিভাগের আধিকারিক (এডিএফও) বিজনকুমার নাথ বলেন, ‘ময়না দুটি পুরোপুরি সুস্থ আছে৷ তারা অনর্গল মানুষের কথা নকল করে পর্যটকদের বেশ মাতাচ্ছে৷’
কোচবিহার জেলায় রসিকবিল প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে ওঠে ১৯৯৫ সালে, বাম আমলে। ১৭৫ হেক্টর এলাকা নিয়ে তৈরি হয়েছে পাখিদের অভয়ারণ্য। অসম লাগোয়া এই প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্রের জলাভূমিতে পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা অন্যতম আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে। সারা বছরই এখানে পানকৌড়ি, বিভিন্ন জাতের স্টর্ক, মাছরাঙা, টিয়া, বালিহাঁস ও লেসার হুইসলিং টিল (ছোট সরাল)কে দেখা যায়। শীত পড়লেই চলে আসে হোয়াইট আইড পোচার্ড (ফেরুজিনাস ডাক), গ্যাডওয়ালরা। প্রতিদিন গড়ে তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো পর্যটক আসেন এখানে। তবে এ বার শীতের মরশুমে গত বছরের রেকর্ড ছাপিয়ে বলে আশা বন দপ্তরের। কেন? ‘ওই মিঠু আর বিঠুর জন্য।’ বলেই একগাল হাসলেন কোচবিহার বন বিভাগের আধিকারিক।