সোমবারই তন্ময়কে প্রায় তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। দুপুর দেড়টা নাগাদ থানায় গিয়েছেন তন্ময়। বেরিয়েছেন বিকেল সা়ড়ে ৪টে নাগাদ। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়ার পর বাড়ি ফিরে বিকেলেই সাংবাদিক বৈঠক করেন তিনি। তাঁর দাবি, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগই অসত্য। যে ঘটনার কথা ফেসবুক লাইভে বলা হয়েছে, তা ঘটেইনি। মহিলা সাংবাদিকের অভিযোগ কেন ‘অসত্য’, তা ‘প্রমাণ’ করতে গিয়ে তন্ময়ের যুক্তি, ‘‘ভদ্রমহিলার ওজন ৪০ কেজির বেশি নয়। আমার ওজন ৮৩ কেজি। ৮৩ কেজি ওজনের এক জন পুরুষ মানুষ যদি ৪০ কেজি ওজনের এক মহিলার কোলে বসে পড়েন, তা হলে সেই মহিলা শারীরিক ভাবে ফিট থাকে কি না, আমি জানি না। এটা পরিকল্পিত কুৎসা।’’ হেনস্থার শিকার হওয়ার পরেও অভিযোগকারিণী মহিলা সাংবাদিক কী ভাবে সারা দিন কাজ করলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তন্ময়।
রবিবার দুপুরে ফেসবুক লাইভে ওই মহিলা সাংবাদিক অভিযোগ করেছিলেন যে, সকালে তিনি তন্ময়ের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর কোলে বসে পড়েছিলেন সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক। ওই ফেসবুক লাইভ বিকেলের মধ্যেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সমাজমাধ্যমে। যার জেরে সিপিএমের অন্দরেও শোরগোল পড়ে। এর পরেই তন্ময়কে সাসপেন্ড করার কথা ঘোষণা করেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। জানান, অভিযুক্ত নেতার বিরুদ্ধে দলের অভ্যন্তরীণ কমিটি (আইসিসি) তদন্ত করবে। সেই তদন্ত যত দিন না শেষ হচ্ছে, তত দিন সাসপেন্ড থাকবেন তন্ময়। সিপিএম সূত্রে খবর, বুধবার রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী বৈঠকে বসবে। সেখানেই এই সময়সীমা এবং আইসিসি-তে বাইরে থেকে আরও কাউকে যুক্ত করা যায় কি না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কথা। আরও কিছু মহিলা সাংবাদিকের সাক্ষ্যগ্রহণ করতে চাইছে সিপিএম। তাঁদের সঙ্গে তন্ময় কী ধরনের আচরণ করতেন, ইয়ার্কির নামে তা মাত্রা ছাড়াত কি না, সে বিষয়েও জানতে চায় দল।
সিপিএমের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অভিযোগকারিণী। রাজনৈতিক পরিচয় দূরে সরিয়ে প্রতিবাদ জানানোর কথা বলেন তিনি। অভিযোগকারিণী সমাজমাধ্যমে লেখেন, “কোনও রাজনৈতিক দল কারও বিচার করতে পারে বলে আমি মনে করি না। তা হলে দেশ জুড়ে সালিশি সভা করেই সব সমস্যার সমাধান করে দেওয়া যেত। আইন-আদালতের প্রয়োজন পড়ত না।” তাঁর সংযোজন, “পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছি। তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেবে আশা করি। এটা রাজনীতি করার সময় নয়, সমাজ সংস্কারের সময়।” সোমবার তন্ময়কে জিজ্ঞাসাবাদের পর অভিযোগকারিণীও বরাহনগর থানায় গিয়েছিলেন। পুলিশ সূত্রে খবর, ওই মহিলা সাংবাদিকের বয়ান সংগ্রহ করা হয়েছে।
গোটা ঘটনায় তন্ময়কে তো বটেই, সিপিএমকেও আক্রমণ করছে বিরোধী দলগুলি। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ সরাসরি তন্ময়কে গ্রেফতার করার দাবি তুলেছেন। এই বিষয়ে সিপিএমের অবস্থান কী জানতে চেয়ে খোঁচা দিয়েছিলেন তিনি। সোমবার এই বিষয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। তৃণমূলের শাসনে নিরপেক্ষ তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাই বিরোধীদের নিরপেক্ষ তদন্ত চাওয়া উচিত। অবশ্য সিপিএম বিরোধী দল কি না আমার জানা নেই।”
রবিবার রাতেই বরাহনগর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন ওই মহিলা সাংবাদিক। তার ভিত্তিতে এফআইআর-ও দায়ের হয়। রবিবারই তন্ময়কে থানায় ডেকে একপ্রস্ত জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল বরাহনগর থানার পুলিশ। সিপিএম সূত্রে খবর, সেই জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি দলকে জানিয়েওছিলেন তন্ময়। রবিবারের পর সোমবারও তাঁকে ফের তলব করে পুলিশ। সেই মতো তন্ময় থানায় যান। প্রায় তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি বেরোন থানা থেকে।
মহিলা সাংবাদিকের যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তন্ময়। তিনি বলেন, ‘‘ভদ্রমহিলা আমার বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন আনুমানিক ১০টা ৪০ মিনিটে। আমার পাশের বাড়ির এক যুবক আমায় রাতে জানিয়েছে যে, মেয়েটি হাসতে হাসতেই বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিলেন। মেয়েটি ফেসবুক লাইভে বলেছেন যে, উনি শারীরিক এবং মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। আমার বক্তব্য হল, যে সময়ে ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করা হয়েছে, তার পরে মেয়েটি প্রায় ২৫ মিনিট আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এর পর আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে মেয়েটির সল্টলেক যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা ছিল ওঁর। ওই সাক্ষাৎকার নিয়ে আমাদের দু’জনের মধ্যেও কথা হয়েছে। আমি ওঁকে একটা প্রশ্নও সাজেস্ট করে দিয়েছিলাম। যিনি এতটা ট্রমাটাইজ় (মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত) হয়ে রয়েছেন, তাঁর পক্ষে কি এত কাজ করা সম্ভব?’’ তাঁর বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ ওঠার পরেই সিপিএম যে পদক্ষেপ করেছে, দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম যে বিবৃতি দিয়েছেন, তার সঙ্গে তিনি সহমত বলেই জানিয়েছেন তন্ময়। সাংবাদিক বৈঠকে প্রাক্তন এক সিপিএম নেতা (বর্তমানে তিনি তৃণমূলে)-র উদাহরণ টেনে তন্ময়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনিও তৃণমূলে যোগ দেবেন কি না। জবাবে তন্ময় বলেন, ‘‘আমি আজন্ম বামপন্থী ছিলাম, আছি এবং থাকবও। এই ঘটনার জন্য আমার পার্টি যদি আমাকে দোষী বলে, তা হলেও আমি বামপন্থী থাকব। আর যদি বলে আমি নির্দোষ, আমি সিপিএম হয়েই থাকব। যদি শেষ পর্যন্ত সিপিএমে আমার থাকা না হয়, তা হলেও আমি বামপন্থী হয়েই থাকব।’’
গত রাজ্য সম্মেলনের পরেই দলে মহিলাদের অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য আইসিসি তৈরি করেছিল সিপিএম। সর্বভারতীয় স্তরেও এমন কমিটি রয়েছে সিপিএমে। বাংলায় সিপিএমের এই কমিটির মাথায় রয়েছেন বর্ধমানের মহিলানেত্রী অঞ্জু কর। তা ছাড়া তালিকায় রয়েছেন রেখা গোস্বামী, আভাস রায়চৌধুরী এবং সুমিত দে। তবে তন্ময়ের বিরুদ্ধে যে তদন্ত হবে সেখানে রেখাকে রাখা হবে কি না, তা নিয়ে সিপিএমে কৌতূহল রয়েছে। কারণ, রেখা উত্তর ২৪ পরগনার নেত্রী। তন্ময়ও উত্তর ২৪ পরগনারই নেতা। ফলে ‘স্বার্থের সংঘাত’-এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রেখাকে বাদ রাখার দাবিও উঠতে শুরু করেছে দলের অভ্যন্তরে। যদিও উত্তর ২৪ পরগনার এক শিক্ষকনেতার বিরুদ্ধে এক মহিলাকে নিগ্রহের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করেছিল সিপিএমের আইসিসি। সেখানে ছিলেন রেখা।