পানিহাটির ত্রাণনাথ কালীবাড়িতে মায়ের পুজোর ভোগে থাকে পঞ্চব্যাঞ্জনের বাহার
বর্তমান | ২৯ অক্টোবর ২০২৪
নিজস্ব প্রতিনিধি, বরানগর: জল থেকে উঠে এসেছিলেন দেবী ভবানী। বাসন অপবিত্র হওয়ায় সকলের সামনেই কাজের মহিলাকে মাটিতে আছাড় মেরে রুদ্র মূর্তি ধারণ করেছিলেন তিনি। নিশুতি রাতে গঙ্গাপাড়ে নূপুর পরে হাওয়া খেতে বের হন করালবদনী। পানিহাটির ত্রাণনাথ কালীবাড়ির মাকে নিয়ে এমনই হাজারো কাহিনি কথিত আছে। মায়ের ভোগেও বৈচিত্র্যের বাহার। রুই, কাতলা, ইলিশ, চিংড়ি, ভেটকি সহযোগে পঞ্চব্যাঞ্জন পছন্দ করেন দেবী। তাই পুজোর দিনে আয়োজনে খামতি রাখেন না সেবাইতরা। ভক্তি ভরে ডাকলে দয়াময়ী মা কাউকে ফেরান না। তাই কালীপুজোর রাতে হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা ও কলকাতা থেকে হাজার হাজার ভক্তের ঢেউ আছড়ে পড়ে মায়ের এই মন্দিরে।
দেগঙ্গার বেড়াচাঁপার মহারাজা চন্দ্রকেতু পানিহাটি গড় তৈরি করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, ওই গড়ে তিনি কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই সকলে গড় ভবানী বলত। এই গড় থেকে দেগঙ্গা পর্যন্ত তিনি রাস্তাও তৈরি করে দিয়েছিলেন। বর্গী হানার সময় সেসব ধ্বংস করা হয়েছিল। আবার অনেকে বলেন, ভবানী মায়ের মন্দির ছিল বেড়াচাঁপায়। বর্গী হানার সময় সেখানেও সব কিছু ধ্বংস করা হয়েছিল। কোনও এক ব্রহ্মচারী দেবীর মূর্তি রক্ষা করেছিলেন সেদিন। বর্তমান সেবাইতদের দাবি, এই দেবীমূর্তি মহারাজা প্রতাপাদিত্যের আমলের। এই মূর্তি স্বপ্নে পেয়েছিলেন চন্দ্রকেতু। এই মূর্তি কয়েকশো বছরের পুরনো। চন্দ্রকেতু গড় ধ্বংসের পর কেটে গিয়েছে বহু কাল। এরপর কলকাতার বাগবাজারের প্রসিদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের এক সদস্যের স্বপ্নে এসেছিলেন মা। বলেছিলেন, পানিহাটির জলে আমি পড়ে রয়েছি। আমাকে তুলে পুজো শুরু কর। এরপর ওই পরিবারের সদস্যরা নৌকায় করে ওই এলাকায় গিয়ে একাধিক পুকুর ও গঙ্গায় জাল ফেলে মায়ের মূর্তি উদ্ধার করেছিলেন এবং গঙ্গাপাড়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এক ব্রহ্মচারীকে পুজোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পরে গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হলে ওই ব্রহ্মচারী নিজেই মায়ের পুজো চালিয়ে যান। তিনি অসুস্থ হলে মায়ের সেবার দায়িত্ব পান পানিহাটির ব্রাহ্মণ নসিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়। নসিরামবাবুর একমাত্র ছেলে ত্রাণনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ত্রাণনাথবাবু অল্প বয়সে বাবা ও মাকে হারিয়ে কার্যত অনাথ হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মায়ের আশিসে ব্যবসা-বাণিজ্য করে পানিহাটির অন্যতম ভূস্বামী হন। আধুনিক পানিহাটির রূপকার তিনিই। পানিহাটি পুরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হওয়ার পাশাপাশি তিনি স্কুল সহ নানা পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ করেন। তাঁর হাত ধরে মায়ের সুবিশাল মন্দির তৈরি হয়। যা আজও লোকমুখে ত্রাণনাথ কালীবাড়ি নামেই পরিচিত।
সেবাইত প্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, মায়ের নিত্যপুজোর পাশাপাশি প্রত্যেক অমাবস্যায় মায়ের বিশেষ পুজো হয়। কালীপুজোর দিন মা চামুণ্ডা রূপে পূজিতা হন। বস্ত্র নিবেদন করা হলেও মায়ের শরীরে ওঠে পুষ্প সাজ। স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিতা হন দেবী। রাতে মহাভোগে অন্ন, পোলাও, খিচুড়ি, পঞ্চব্যাঞ্জন, ইলিশ, চিংড়ি, ভেটকি, কাতলার নানা পদ, দই ও মিষ্টি থাকে। মায়ের আশীর্বাদে কত ভক্ত উপকৃত হয়েছেন, তার কোনও হিসেব নেই। আজও মধ্যরাতে মেলে নূপুরের আওয়াজ। মা কোনও কোনও ভক্তের উপর ভর করে আজও প্রকট হন। কালীপুজো ও ভাদ্র মাসের অমাবস্যা ছাড়া মায়ের মন্দির ও নাট মন্দির শুনশান রাখতে হয়। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে কত বিপ্লবী মায়ের কাছে মাথা
ঠেকিয়ে গিয়েছেন। উত্তমকুমারের ‘বউ ঠাকুরানি’ ছবির শ্যুটিং এই মন্দির ও লাগোয়া গঙ্গার ঘাটে হয়েছে। তিনটি শিব মন্দিরেও নিত্যপুজো হয়।