তন্ময়কে সাসপেন্ড করার পরে আপাতত নতুন করে পুরনো ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। যা প্রাক্ সম্মেলন পর্বে সিপিএমের মধ্যে নতুন ‘উত্তেজনা’ তৈরি করেছে। তবে সিপিএমের রক্তক্ষরণ যে অব্যাহত রয়েছে, তা একের পর এক ভোটে প্রমাণিত। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর সিপিএম বিভিন্ন ভাবে নিজেদের ‘সংহত’ করেছে। দলীয় শৃঙ্খলার বিষয়ে যত্নবান হয়েছে। নেতৃত্বে মহম্মদ সেলিমকে এনেছে। পাশাপাশি, মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় বা দীপ্সিতা ধরের মতো নতুন মুখ তুলে এনেছে। কিন্তু তার পরেও তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একশ্রেণির মধ্যে ‘জনমত’ গড়ে উঠলেও সিপিএম তার রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, সেই কারণেই সিপিয়েম খড়কুটো পেলেও তা আঁকড়ে ধরছে। কিন্তু তাতে লাভ হবে কি না, তা নিয়েও কেউ নিশ্চিত নন। কারণ, অনেকের মতে, সমস্যা সিপিএমের নয়। সমস্যা কমিউনিজ়মের। সারা পৃথিবী থেকেই কার্যত কমিউনিজ়মের পাট উঠে গিয়েছে। চিন বা ভিয়েতনামের মতো যে সব দেশের দল এখনও নিজেদের ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ বলে, তারাও বামপন্থী আদর্শ সে ভাবে ধরে রাখেনি। যদিও এ দেশে এখনও সিপিএম পলিটব্যুরো ইত্যাদির মতো পুরনো বামপন্থী কাঠামো ধরে রেখেছে! অনেকের মতে, আলিমুদ্দিন লড়াই করছে ইতিহাসের সঙ্গে। সেই কারণেই তারা কোনও ‘সুযোগ’ ছাড়তে চাইছে না। তন্ময়কে তড়িঘড়ি সাসপেন্ড করাও তারই অঙ্গ।
তন্ময়কে সিপিএম যেমন দলীয় ভাবে সাসপেন্ড করেছে, তেমন আইনি প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। মহিলা সাংবাদিক বরাহনগর থানায় অভিযোগ করেছেন। তার ভিত্তিতে সোমবার থানায় ডেকে তন্ময়কে ঘণ্টা চারেক জিজ্ঞাসাবাদও করেছে পুলিশ। তবে তন্ময়কে যে ভাবে রাজ্য সিপিএম ‘তড়িঘড়ি’ সাসপেনশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে দলের অন্দরেও অনেকে বিস্মিত।
রবিবার দুপুরে এক মহিলা সাংবাদিক ফেসবুকে লাইভ করে অভিযোগ করেন, তিনি তন্ময়ের বরাহনগরের বাড়িতে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন। তখন তন্ময় তাঁর কোলে বসে পড়েন! বিকেলেই সিপিএম নেতৃত্ব বুঝিয়ে দেন, তাঁরা তন্ময়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করবেন। সন্ধ্যায় রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম তন্ময়কে সাসপেন্ড করার কথা ঘোষণা করেন। সিপিএমের এই ‘তৎপরতার’ নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, আরজি কর-আবহে আলিমুদ্দিন জনমানসে একটা ধারণা করতে চেয়েছে যে, তারা দলগত ভাবে এই বিষয়গুলি বরদাস্ত করে না। অর্থাৎ, তারা ‘অভিযুক্ত’ এবং ‘দোষী’র মধ্যে ফারাক করে না (নবান্নের বৈঠকে ওই বিষয়ে এক জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথোপকথন স্মর্তব্য) । যদিও দলের অনেকে আবার সেই ‘তত্ত্ব’ মানতে রাজি নন। দ্বিতীয়ত, পেশাগত কাজ করতে গিয়ে এক তরুণী হেনস্থা হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। যাকে সিপিএম বাড়তি ‘গুরুত্ব’ দিতে চেয়েছে। তৃতীয়ত, ওই লাইভের পরে সিপিএমের নেতা-কর্মীরাই সমাজমাধ্যমে সরব হতে শুরু করেন। সেই পরিস্থিতিতে তন্ময়কে ‘আপাতত’ সাসপেন্ড করা ছাড়া উপায় ছিল না। চার, পুরনো কিছু ছবি এবং ঘটনা নিয়ে তন্ময় সম্পর্কে দলে ফিসফাস ছিল। অনেকের মতে, সাম্প্রতিক অভিযোগ ওঠার পরে সেগুলি ‘এক’ করে দেখতে চেয়েছে রাজ্য সিপিএম।
সেলিম জানিয়েছেন, তন্ময়ের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে তদন্ত করবে দলের ‘ইন্টারনাল কমপ্লেন কমিটি’ (আইসিসি)। সেই কমিটি সমগ্র ঘটনার তদন্ত করে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীকে রিপোর্ট দেবে। তবে তন্ময়কে যে সাসপেন্ড করা হয়েছে, তা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন স্বয়ং রাজ্য সম্পাদক। ঘটনাচক্রে, সিপিএমের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাসপেন্ড হওয়াও এক ধরনের শাস্তিই। এই প্রেক্ষাপটে দলে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, তন্ময়ের ক্ষেত্রে রাজ্য সিপিএম তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নিলেও পিডিজি ভবন বা ক্যাল ডিসি (কলকাতা জেলা সিপিএমের সদর দফতর) সেই ‘দৃঢ়তা’ দেখাতে পারেনি।
অথচ, সিপিএমে অন্দরে ক্যাল ডিসি বরাবরই ‘দৃঢ় এবং বৈপ্লবিক’ ভূমিকা পালন করে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের ২২টি জেলা কমিটি আছে। শুধু কালিম্পং ছাড়া। সেখানে সাংগঠনিক কমিটি আছে। কিন্তু সবগুলির মধ্যে কলকাতা জেলা কমিটি বা ক্যাল ডিসি-র ‘দাপট’ সবচেয়ে বেশি। তার একটি কারণ যদি হয় এটি রাজ্যের প্রাণকেন্দ্রে জেলা, তা হলে অন্য কারণ হল এর সাংগঠনিক ক্ষমতা। কলকাতায় কোনও কর্মসূচি করতে হলে সিপিএম যার উপর নির্ভরশীল থাকে।
বছর দুয়েক আগে দক্ষিণ কলকাতার এক যুবনেত্রীকে রাস্তায় ফেলে পেটানোর অভিযোগ উঠেছিল একই এরিয়া কমিটির এক তরুণ নেতার বিরুদ্ধে। ওই তরুণীর অভিযোগের ভিত্তিতে দলে তদন্তের পরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে ওই তরুণ নেতাকে প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে এক বছরের জন্য সাসপেন্ড করেছিল দল। সিপিএমের নিয়মানুযায়ী, কাউকে সাসপেন্ড করলে তা দলের মধ্যে অন্তত ঘোষণা করতে হয়। তন্ময়ের ক্ষেত্রে যা সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা করেছেন সেলিম, সেটি দক্ষিণ কলকাতার ওই নেতার ক্ষেত্রে হয়নি। এমনকি, সিপিএমের অনেক প্রথম সারির নেতাও একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন, সে ক্ষেত্রে ক্যাল ডিসি-র ‘দৃঢ়তার অভাব’ ছিল। তারা সাহসের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
উল্লেখ্য, যে যুবনেত্রীকে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়েছিল বলে অভিযোগ, তিনি ক্ষোভে পরবর্তী কালে দলের এরিয়া কমিটির সদস্যপদও ছেড়ে দেন। যদিও দলীয় কর্মসূচি থেকে সরে আসেননি। আবার যে নেতাকে নারীনিগ্রহের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে দল এক বছরের জন্য সাসপেন্ড করেছিল, তাঁকে দেখা গিয়েছে আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে সিটুর সভায় বক্তৃতা করছেন!
তন্ময় উত্তর ২৪ পরগনার নেতা। ওই জেলারই এক নেতার বিরুদ্ধে দু’বছর আগে নিগ্রহের অভিযোগ তুলে দলে অভিযোগ জানিয়েছিলেন এক মহিলা। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে আইসিসি তদন্ত করেছে। কিন্তু তন্ময়ের ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই ওই মহিলা দাবি করেছেন, তিনি যে নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন, সেই নেতার বিরুদ্ধে সিপিএম ব্যবস্থা নেয়নি। সোমবার রাতে তিনি এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে বিচার চেয়েছেন। এমনকি, পোস্টে অভিযুক্ত নেতার নামও উল্লেখ করে দিয়েছেন। সেলিম অবশ্য বলেছেন, ‘‘আইসিসি তদন্ত করেছিল। সেই রিপোর্ট জেলাতেও পাঠানো হয়ে গিয়েছে।’’ কিন্তু অভিযোগকারিণীর দাবি, বারাসতের সিপিএম জেলা দফতর থেকে তাঁকে কিছুই জানানো হয়নি। অথচ তিনি দেখছেন, যাঁর বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করেছিলেন, তিনি বহাল তবিয়তে সিপিএমের সভায় বক্তৃতা করছেন। উঠে আসছে বারাসতের এক যুবনেতার প্রসঙ্গও।
সিপিএমের ভোট নেই। কিন্তু প্রথম সারির নেতারাও মানেন, এখনও বহু লোকের কমিটি আঁকড়ে থাকার ‘মোহ’ রয়েছে। ২০১৭ সালে দলের দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলার সম্মেলনে গিয়ে বিমান বসু বলেছিলেন, ‘‘এক জনকে লোকাল কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সেই নেতা আমায় এসে বলছে, আমার তো এই পদটা রইল না। এ বার আমি শ্যালক-শ্যালিকাদের কী বলব?’’ বিমান বোঝাতে চেয়েছিলেন, কমিটির পদে থাকাকে কেউ কেউ ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ হিসাবে দেখাতে চাইছেন। সিপিএমের এরিয়া স্তরের সম্মেলন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে জেলাগুলির সম্মেলন হবে। এই পর্বে তন্ময়ের বিরুদ্ধে ‘অভিসন্ধি’ করা হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও তুলছেন দলের কেউ কেউ। তন্ময়ও ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, তিনি মনে করেন সম্মেোলনের আগে তাঁকে ‘চক্রান্ত’ করে ‘ফাঁসানো’ হয়েছে। প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘‘পরিকল্পিত কুৎসা।’’ অনেকে উত্তর ২৪ পরগনা সিপিএমের গোষ্ঠী রাজনীতির সমীকরণেও বিষয়টিকে দেখতে চাইছেন।
তবে আপাতত সিপিএম ‘তন্ময়ময়’। প্রাক্তন এই বিধায়ককে কেন্দ্র করে যে আলোচনা আবর্তিত হচ্ছে, সেই কক্ষপথে ঢুকে পড়ছে বহু পুরনো ঘটনাও। যে সব ঘটনায় তদন্ত হলেও তাকে ‘প্রহসন’ বলে উল্লেখ করে থাকেন দলেরই অনেকে। তন্ময় সংক্রান্ত ‘দৃঢ়’ সিদ্ধান্ত ঘটনা কি সেই ‘নকল বুঁদির গড়’ রক্ষা করতে পারবে? তন্ময়কে তড়িঘড়ি সাসপেন্ড করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের রাজ্য কমিটি, তা কি ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা কমিয়ে আনতে পারবে?