কলকাতার এই ১৮টি জায়গায় ভূত আছে? অনেকেই নাকি অস্তিত্ব টের পেয়েছেন
আজ তক | ৩০ অক্টোবর ২০২৪
ভূত চতুর্দশী বুধবার, ৩০ অক্টোবর পালন করা হবে৷ এই দিনটি দীপাবলি উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ৷ দিনটি মা কালীকে সম্মান জানাতে এবং ব্যক্তি ও পরিবারকে রক্ষা করে এমন আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রেতাত্মা এবং নেতিবাচক শক্তিকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য নিবেদিত। অশুভ শক্তির থেকে মুক্তির জন্যই এমন দিনে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানোর রীতি প্রচলিত। অনেকে আবার মনে করেন, এই দিনে দৈত্যরাজ বলি পৃথিবীতে আসেন পুজো নিতে, তাঁরই সঙ্গে আসে বহু অশুভ শক্তি। তাই এমন দিনে অশুভ শক্তির পরাজয়কে কামনা করে ১৪ প্রদীপ দেওয়া হয়।
কালীপুজোর সঙ্গে ভূতপ্রেতের সম্পর্ক অস্বীকার করা যায় না। এক তো কালীপুজোর আগের রাতেই পালিত হয় ভূত চতুর্দশী। তার ওপর কালীর করালবদনী মূর্তির পাশে অনেক জায়গাতেই থাকে ডাকিনী প্রেতিনীদের মূর্তিও। এই অমাবস্যা ভূতপ্রেতদের অত্যন্ত প্রিয় বলেও মনে করা হয়।
আমাদের দেশের অনেক জায়গাই ভুতুড়ে বলে পরিচিত। যেমন রাজস্থানের ভানগড় ফোর্ট, মুম্বইয়ের মুকেশ মিলস বা কার্সিয়ং-এর ডাও হিল। সেই সব জায়গায় ভূতের দেখা পেতে রীতিমত গাঁটগচ্চা খরচ করে ভিড় করেন বহু পর্যটক। তবে আমাদের এই শহরেই এমন অনেক জায়গা আছে, যেগুলি ভুতুড়ে হিসেবে রীতিমত পরিচিত। এই সব জায়গায় অনেকেই বিভিন্ন সময় অশরীরীর উপস্থিতি অনুভব করেছেন। ভূত বিশেষজ্ঞদের মতেও কলকাতার অনেক জায়গাতেই প্রেতাত্মার উপস্থিতি আছে। যাঁরা ভূত মানেন না, তাঁরা এসব কথায় কান না দিলেও ভূত প্রেতের প্রতি আগ্রহ কিন্তু মানুষের চিরকালীন। দেখে নেওয়া যাক কলকাতার কোন কোন জায়গায় অশরীরীর খোঁজ পেতে পারেন আপনি।
ন্যাশনাল লাইব্রেরি
আলিপুর চিড়িয়াখানার কাছে ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে সারা পৃথিবীর দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য, দুর্লভ সব বইয়ের সংগ্রহের পাশাপাশি আছে রহস্যময় ভৌতিক কান্ডকারবারও! শোনা যায়, সুবিশাল লাইব্রেরির অনেক রক্ষী রাতের অন্ধকারে এক মহিলার কান্না শুনতে পান। কথিত আছে, লর্ড মেটক্যাফের পত্নীর আত্মা ঘুরে বেড়ায় সেখানে। এমনকি দিনের বেলাতেও কোনও বই নিয়ে সেটা পড়ার পর ঠিক মতো 'সেলফ্' বা তাকে তুলে না রাখলে আপনার ঘাড়ের কাছে কারও ভারী নিঃশ্বাসের ফোঁসফোঁস আওয়াজ শুনলেও শুনতে পারেন!
রাইটার্স বিল্ডিং
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাইটারদের জন্য পরাধীন ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাইটার্স বিল্ডিং। এখানেই ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর তিন প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনয়, বাদল এবং দীনেশ পুলিশের তত্কালীন ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন। অনেকে বলেন এখনও রাইটার্স বিল্ডিং-এ সিম্পসনের আত্মা ঘুরে বেড়ায়। রাতে ফাঁকা রাইটার্সে পায়ের শব্দ, কান্নার আওয়াজ শুনেছেন অনেকেই। সন্ধের পর এখানে সচরাচর থাকতে চান না কেউ। বিশেষ করে সিম্পসনকে যেখানে মারা হয়েছিল, সেই পঞ্চম ব্লকে অশরীরীর উপস্থিতির কথা শোনা যায় সবথেকে বেশি।
হেস্টিংস হাউস
আলিপুরে ব্রিটিশ আমলের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বারা নির্মিত ভবনটি হেস্টিংস হাউস নামে পরিচিত। বর্তমানে এটি মহিলাদের কলেজ। এই কলেজের অনেক ছাত্রীই এখানে রহস্যময় এক ব্যক্তিকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। তিনি ঘোড়ায় চড়ে কোনও কিছুর সন্ধানে যেন ঘুরে বেড়ান। অনেকে বলেন যে শেষ বয়সে হেস্টিংস খুব দুঃখের সঙ্গে কাটিয়েছেন। তাঁর আত্মা জীবদ্দশায় শান্তির খোঁজ পায়নি। মৃত্যুর পরও তাই শান্তি খুঁজে বেড়ান হেস্টিংস।
মল্লিকঘাট
হাওড়া ব্রিজের নীচে মল্লিকঘাট ফুলবাজারের সামনের ঘাটেও ভূতের অস্তিত্ব টের পান অনেকেই। এখানে আবার সাদা শাড়ি পরিহিত পেত্নী নাকি ঘোরে। যাঁরা নিয়মিত যাতায়াত করেন, তাঁরা নাকি প্রতিদিন একটা না একটা ভৌতিক কাণ্ডকারখানার স্বাক্ষী থেকেছেন। কখনও দেখেন এক মহিলাকে সাদা শাড়ি পরে ঘুরতে। কখনও নাকি-সুরে কান্নার আওয়াজও পাওয়া যায়। লোকেদের ধারণা, গঙ্গায় ডুবে কোনও মহিলার মৃত্যু হয়েছিল। তাঁর আত্মাই এখন ঘুরে বেড়ায়।
নিমতলা শ্মশানঘাট
কলকাতার বিখ্যাত শ্মশানঘাট নিমতলা। অমবস্যার রাত এলেই এখানে নাকি তেনাদের আনাগোনা শুরু হয়। তারপর ভূত চতুর্দশীর বিশেষ দিনে তো কথাই নেই। কত নাকি অশীরীরি আত্মার বিচরণ ঘটে এই নিমতলা ঘাটে। কত রকমের অলৌকিক ঘটনা ঘটে। তবে এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এখানে বহু মানুষের শবদাহ হয়। তাই সেখানে অশীরির আত্মার বিচরণ করা অস্বাভাবিক ঘটনা নয় তাঁদের কাছে।
লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থান
লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরস্থানে শায়িত রয়েছে স্যার উইলিয়াম হে ম্যাকনটন। প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে তিনি নিহত হয়েছিলেন। তাঁর দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল এই গোরস্থানে। স্যর উইলিয়ামের স্ত্রী স্বামীর ছিন্নভিন্ন দেহ আফগানিস্তান থেকে নিয়ে এসে সমাধিস্থ করেছিলেন কলকাতায়। উইলিয়াম সাহেবের এই সমাধির কাছে গেলেই কবরের সামনে ছায়াদানকারী গাছটি কাঁপতে থাকে। কথিত আছে, উইলিয়ামের ক্ষুব্ধ আত্মার আস্ফালনেই কাঁপে গাছটি।
দক্ষিণ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান
পার্কস্ট্রিটের এই গোরস্থানে বেশিরভাগ সমাধিই ব্রিটিশ সৈন্যদের। কলকাতার সবথেকে পুরনো এই কবরস্থান নিয়ে অনেক গল্প রয়েছে। অনেকেই এই জায়গা পরিদর্শন করে অনেক অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছেন। একবার এক দল যুবক এই কবরস্থানের ফটো তুলেছিলেন। সেই ছবিতে কিছু অদ্ভুত আকৃতি ধরা পড়ে। পরে ওই যুবকরা প্রত্যেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
কলকাতা হাইকোর্ট
১৩ নম্বর কোর্ট রুম। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এখান থেকেই। অনেকের দাবি, এখনও গভীর রাতে রক্তাক্ত পা হেঁটে গিয়ে ঢোকে ওই কোর্ট রুমে।
আকাশবাণী
কলকাতার পুরনো ভুতুড়ে বাড়ির মধ্যে এক নম্বর গারস্টিন প্লেস এবং দ্বিতীয় এর প্রথম অফিস। আকাশবাণীর পুরনো দফতর গারস্টিন প্লেসে বারবার দেখা গিয়েছে অশরীরী আত্মা। ফাঁকা লম্বা করিডর, অজস্র স্টুডিও আর ব্রিটিশ অবকাঠামো মিলিয়ে আকাশবাণীর ভুতুড়ে অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। রাত গভীর হলে অনেকেই দেখেছেন সাহেবের ছায়া উবু হয়ে কাজ করছে। আবার কেউ কেউ দেখেন মধ্যরাতে রেকর্ডিং রুমের বারান্দায় কে যেন গান শুনছেন। হয়তো বেতারের আশ্চর্য বিজ্ঞানী সে যুগের মনে জন্ম দিয়েছিল এসব ভুতুড়ে বিশ্বাসের। এখনো নানা স্টুডিও থেকেই রাতে ভেসে আসে যান্ত্রিক সুর। বলাই বাহুল্য, সেই যন্ত্রগুলো কোনো মানুষ বাজায় না।
রেসকোর্স
ঘোড় প্রতিযোগিতায় মুখরিত থাকে ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব খ্যাত রেসকোর্স ময়দানেও নাকি তেনারা রয়েছে। রাতে এখানে ঘটে যায় অলৌকিক সব ঘটনা। কে বা কারা যেন ঘোড়া নিয়ে ছুটে বেড়ান এখানে। স্পষ্ট দেখতে পাওয়া ঘোড়া নিমিষেই বাতাসে মিলিয়ে যায়। ইতিহাসে রয়েছে একটি কাহিনি। রয়্যাল পরিবারের ব্রিটিশরা এখানে ঘোড় সওয়ার করতেন। একবার এক ব্রিটিশ জর্জ উইলিয়ামস তার বিখ্যাত সাদা ঘোড়া নিয়ে ময়দান চষিয়ে বেড়াতেন। অপরূপ সাদা ঘোড়াটির নাম ছিল পার্ল হোয়াইট। প্রচুর রেস আর ট্রফি জেতায়, পার্ল হোয়াইটকে তখনকার সময় এক নামেই চিনত। উইলিয়ামস ঘোড়াটিকে নিজের প্রাণের চাইতেও বেশি ভালোবাসতেন।
পুতুলবাড়ি
হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত পুতুলবাড়ি এই শহরের আরও একটি ভৌতিক জায়গা। এই বাড়িতে কিছু অসাধারণ পুতুলের সংগ্রহ আছে। ধনী বাবুদের হাতে দীর্ঘদিন ধরে যৌন অত্যাচারিতা হতেন যে মহিলারা, তাঁদের আত্মা এখনও এই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায় বলে অনেকের বিশ্বাস। বিশেষ করে এই বাড়ির ওপরের তলার বদনাম সবচেয়ে বেশি। চুরির রিনিরিনি আওয়াজ, নুপূরের ঝমঝম শব্দ, মিঠে হাসির সুর এখনও কানে বাজে প্রায়শই। আশেপাশের বাসিন্দারাও নাকি এই ঘটনার সাক্ষী।
হাওড়া ব্রিজ
১৯৪৩ সালে আম জনতার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল হাওড়া ব্রিজ। কলকাতার গর্ব এই ব্রিজ শুধু এর সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত নয়, এটিও কলকাতার ভুতুড়ে স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম। বহু সময় বহু মানুষ হাওড়া ব্রিজ গঙ্গার জলে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ভোর ৩টে নাগাদে এখানে অনুশীলন করেন কুস্তিগীররা। তাঁরা অনেকেই জলের ওপর ভাসমান একটা হাত দেখেছেন। কেউ ডুবে যাচ্ছে ভেবে যিনি সাহায্য করতে গিয়েছেন, তিনি নিজেও আর ফিরে আসেননি। রাতের বেলা সাদা শাড়ি পরে এক মহিলাকেও ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছেন অনেকে।
রাইটার্স বিল্ডিং
একদা রাজ্যের মূল প্রশাসনিক ভবন। এই বাড়ির ফাঁকা ঘরগুলিই ছিল ভূতের বাসস্থান। রাত নামলেই তাঁদের হুড়োহুড়ি শুরু হয়। এমনকী এমনই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, কেউ ওই ফাঁকা ঘরগুলির আশেপাশের ঘরগুলিতে থেকে কাজই করতে পারতেন না। কেউ সাহসও করতেন না সন্ধ্যার পর ওই ঘরগুলির আশেপাশে একা যাওয়ার। মাঝরাতে কান্নার আওয়াজও পাওয়া যায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের থেকে এই তথ্য জানা গিয়েছে।
রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন
এই স্টেশনেই নাকি আড্ডা বসায় ভূতের দল। একেবারে গোলটেবিল বৈঠক শুরু হয় রাত নামলেই। যাঁরাই শেষ মেট্রায় সওয়ারি হয়ে রবীন্দ্র সরোবর স্টেশনে নেমেছেন, তাঁরা সাক্ষী থেকেছেন ভুতুড়ে কাণ্ডের। রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনে নাকি যাত্রীরা বিভিন্ন ছায়ামূর্তিকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। যাত্রীদের ব্যাখ্যা, মেট্রোর লাইনে ঝাঁপ দিয়ে যাঁরা আত্মহত্যা করেন, তাঁদের অশীরীরি আত্মাই সন্ধ্যার পর এই স্টেশনে এসে মিলিত হন। শোনা যায়, কলকাতার অন্য মেট্রো স্টেশনগুলির তুলনায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে এখানেই।
গার্স্টিন প্লেস
এখনও রাতে পিয়ানোর সুর শোনা যায় গার্স্টিন প্লেসের পোড়ো বাড়িটা থেকে।
কলকাতা ডক
কলকাতা ডক বা খিদিরপুর ডক হল কলকাতার এক বহু পুরনো ডক। কথিত, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্যের কালে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে ব্রিটিশেরা বিশ্বাসঘাতকতা করে মেরে ফেলেছিল এই ডকেই। বিভিন্ন সময়ে বহু নাবিক ও ব্যবসায়ী নাকি এই অঞ্চলে একটি ছায়াকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছেন। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, সেই ছায়া নবাবের শোকাহত আত্মার।
জেনারেল পোস্ট অফিস (জিপিও)
এই বাড়িটিও ভূতুড়ে বলে কুখ্যাত। বহু অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন এখানকার কর্মচারীরা। অচেনা মানুষের ছায়া, রাতে অপ্রত্যাশিত পায়ের শব্দ, কথা বলার শব্দ, হঠাৎ ঠান্ডা আবহাওয়া ইত্যাদি এখানে নাকি প্রতিনিয়তই অনুভব করা যায়।
জাদুঘর
কলকাতায় জাতীয় জাদুঘরেও অনেক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন এখানে রাতপাহারায় থাকা কর্মীরা। পায়ের শব্দ, হাসি-কান্নার শব্দ তাঁরা নাকি শুনতে পান মাঝেমধ্যেই। এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ