মেঠো পথ থেকে সিনেমার পর্দায় ননীচোরা মরা গাঙে জোয়ার ‘বহুরূপী’ গ্রামে
বর্তমান | ৩০ অক্টোবর ২০২৪
সৌম্যদীপ ঘোষ, সিউড়ি: গান দিয়ে যায় চেনা…। এতদিন সেই গানই গাঁ-গঞ্জে চিনিয়েছে ননীকে। গ্রামের মেঠো রাস্তায় কখনও তিনি কৃষ্ণসাজে। কখনও তিনি রাক্ষস। কখনও তিনি মা কালী। আবার কখনও তিনি গোয়ালিনি। গলায় সুর ভাজছেন গুন গুন করে। সুরকে আয়ত্ত্বে এনেই গেয়ে চলেছেন হরেক লোকগান। উঁচু স্কেলে বাঁধা বাউল কিংবা ভাটিয়ালি।
লোকে বলে, গাইতে গাইতে গায়ক। ননীও তাই। কিন্তু তাঁর গান এতদিন মেঠো পথ আর সবুজ বনানিতে ধাক্কা খেতে খেতে ফিরে আসত তাঁরই নিজের কাছে। কখনও পথিক-সাক্ষাৎ হলে হয়তো দু’-চার টাকা পড়ত ননীর ঝুলিতে। কিন্তু বোঝা যেত না, গান ভালোবেসে এই দান, নাকি ননীর সাজে মুগ্ধ হয়ে! আসলে, একই অঙ্গে এত রূপের সঙ্গে সঙ্গীত প্রতিভাকে গুলিয়ে ফেলতেন সকলেই। তাই, ননী একজন সঙ্গীত সাধক হিসেবে যত না সমাদৃত, তার চেয়ে ঢের বেশি জনপ্রিয় বহুরূপী হিসেবে। আজ সেই ননীকে গোটা বিশ্ব চিনেছে বাংলার লোকশিল্পের যুগ্ম সত্ত্বার ধারক ও বাহক হিসেবে। সৌজন্যে ‘বহুরূপী’। ‘মটর কলাই গোল গোল, দাঁতে ভাঙে না। ওই পাড়ার শাশুড়ি বৌমারা চেনে না।’—চোখে-মুখে কড়া রং। বাহারি পোশাক। মেঠো পথ ছেড়ে সিনেমার পর্দায় গেয়ে চলেছেন ননী। সেই গান এখন নেটবিশ্বে ভাইরাল।
‘বহুরূপী’ আসলে একটি থ্রিলার সিনেমা। রূদ্ধশ্বাস চিত্রনাট্যের কোলাজ। বাংলার একটি সিরিজি ডাকাতির ঘটনা নিয়ে তৈরি। পুলিস ও দুষ্কৃতীদের স্নায়ুর যুদ্ধ মূলত এই সিনেমার উপজীব্য। সেখানে বাংলার দু’টি লোকশিল্পকে নিখুঁত কৌশলে মিশিয়েছেন পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়। এরজন্য একটি চরিত্র সৃষ্টি করতে হয়েছে তাঁদের। সেই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ননী। পুরো নাম ননীচোরা চৌধুরী ব্যাধ।
বীরভূমের লাভপুরের বিষয়পুর গ্রামে বাড়ি ননীচোরার। গ্রামটি ‘বহুরূপী’ গ্রাম বলে জেলায় সমধিক পরিচিত। একদা গ্রামের প্রায় সকলেই রূপ বদলের পেশায় ছিলেন। এখন স্মার্ট ফোনের যুগ। বর্তমান প্রজন্ম রিলসে মুখ গুঁজে। ‘বহুরূপী’ যে বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প, সেটা তাঁদের কাছে বিস্মৃতপ্রায়। আশির দশকে প্রথিতযশা চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়ের কলমে ধরা পড়েছিল এই লোকশিল্পের কথা। লিখেছিলেন ‘বহুরূপী’ শীর্ষক একটি গল্প। নিকুঞ্জ সাহা নামে ‘বহুরূপী’ ছিলেন গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে। পরে সেই গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে ওয়েব সিরিজ। অভিনয় করেছেন কে কে মেননের মতো অভিনেতা। এবার সেলুলয়েডে নতুন আঙ্গিকে ‘বহুরূপী’ লোকশিল্পকে তুলে ধরলেন শিবপ্রসাদ-নন্দিতা। পরিচালক শিবপ্রসাদ বলছিলেন, ‘মুম্বই থেকে আমার এক বন্ধু বলছিলেন, সেখানে সিনেমা দেখতে যাওয়া বাচ্চাদের অভিভাবকরা বোঝাচ্ছেন বহুরূপী আসলে কী। এটাই আমাদের সাফল্য। আগে গাঁ-গঞ্জে লোককথা জানাতেন এঁরাই। বাচ্চারা বহুরূপীর নাম শুনলে দ্রুত খেয়ে নিত। পুলিসের চরের কাজ করতেন। সমাজকে নানাভাবে সাহায্য করে গিয়েছেন। ওঁদের এই অবদান কম নয়। ননী তাঁদেরই একটা অংশ।’
স্বভাবতই ননীচোরাকে আইকন মেনে এখন বিষয়পুরে মরা গাঙে জোয়ার। অহঙ্কার আঁকড়ে বাঁচতে চাইছেন বহুরূপী শিল্পীরা। কিন্তু, কেমন ছিল ননীচোরার স্বপ্নের এই যাত্রাপথ? কথায় কথায় তিনি বলছিলেন, ‘সকালে আয়না আর রঙ নিয়ে সাজতে বসি। তারপর গ্রামে গ্রামে বহুরূপী সেজে ঘুরে বেড়াই। কার্তিক দাস বাউলের কাছে বাউল গানও শিখেছি। বাবা সনাতন চৌধুরী ব্যাধের কাছে বহুরূপী শিল্পে হাতি খড়ি। আমাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য পরিচালক শিবুদার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’ কথা হচ্ছিল বিষয়পুর গ্রামের বৃদ্ধ উত্তম কুমার মণ্ডল বহুরূপীর সঙ্গে। বলছিলেন, ‘গ্রামে এখনও ৫০টি পরিবার বহুরূপী সেজে সংসার চালান। ননী ছোট হলেও ওঁর সাফল্যে আমরা সত্যিই খুশি। বহুরূপীদের গবেষণাধর্মী তিনটি বই লিখেছেন আদিত্য মুখোপাধ্যায়। তিনি বলছিলেন, ‘বিষয়পুর, শীতলগ্রামের ব্যাধরাই এখন পেশায় বহুরূপী। সকালে মুখে রঙ না মাখলে এদের পেটের খাবার জোটে না। শেষ হয়ে যাওয়া এই লোকশিল্পটি বাঁচুক। সেটাই মনপ্রাণে চাই।’ • নিজস্ব চিত্র