পিনাকী ধোলে ও সজল মণ্ডল, কাশীপুর: সরকারি খাতায় কলমে চাকরি করেন দিদি। চাকরি বলতে স্কুলশিক্ষিকা। কিন্তু ঘটনা হল, দিদি স্কুলেই আসেন না। তাঁর হয়ে প্রক্সি দিচ্ছেন ভাই! নিয়মিত তিনি স্কুলে আসছেন। ছাত্রীছাত্রীদের পড়াচ্ছেন। শখ করে এভাবে অনেকের ক্লাস নেওয়ার ঘটনা আকছার ঘটে। সেটা খুব বড়জোড় হলে এক বা দু’দিন। এক্ষেত্রে বিষয়টা একেবারে তা নয়। বছরের পর বছর দিদির ‘ডামি’ শিক্ষক হিসেবে পড়িয়ে যাচ্ছেন ভাই। সব জেনেও যেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে গ্রামবাসীরা।
ঘটনাটি পুরুলিয়া জেলার কাশীপুর ব্লকের ইন্দ্রবিল চক্রের তুলদেড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। মাস কয়েক আগে এমনই একটি ঘটনাকে ঘিরে শোরগোল পড়েছিল পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়। চণ্ডীপুরের এক স্কুলের শিক্ষক তথা প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা স্কুলে না গিয়ে ‘ডামি’ দিয়ে পড়াতেন। বিষয়টি ফাঁস হতেই নড়েচড়ে বসে জেলা স্কুলশিক্ষা দপ্তর। ওই নেতাকে শোকজ করেছিলেন ডিআই। এক্ষেত্রে কী হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। কেননা, দীর্ঘদিন দিদির হয়ে ভাইয়ের শিক্ষকতার বিষয়ে অবগত স্কুলের হেড মাস্টার, এসআই থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিরা। অথচ, এই অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে কেউই রা কাড়েননি। কিন্তু কেন? জবাবে গ্রামবাসীদের একাংশ বলেন, ওই ডামি শিক্ষক অত্যন্ত প্রভাবশালী। শাসকদলের নেতাদের সঙ্গে ওঁর দহরম মহরম সর্বজনবিদিত।
কাশীপুর ব্লকের একেবারে শেষ প্রান্তে মণিহারা গ্রাম পঞ্চায়েত। সেই গ্রামে অবস্থিত তুলদেড়িয়া স্কুল। যাঁকে ঘিরে বিতর্কের সূত্রপাত তিনি শ্যামা মুখোপাধ্যায়। মণিহারা গ্রামেই তাঁর বাড়ি। বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। চাকরি জীবন শেষ হওয়ার পূর্বেই তিনি মারা যান। ১৯৯৭ সালে সেই চাকরিটি পান শ্যামাদেবী। তাঁর পরিবারের দাবি, ২০০৪ সাল নাগাদ শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তারপর থেকে বহুবার অসুস্থতার কারণে ছুটি নিয়েছেন। তখন থেকে শিক্ষকতা ও চিকিত্সা চলেছে সমান্তরালভাবে। ফের তিনি ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা দু’বছর ছুটিও নেন। তারপর থেকেই শ্যামাদেবী আর স্কুলে আসেননি বলে অভিযোগ। তাঁর হয়ে প্রক্সি দিতে শুরু করেন ভাই। তখন থেকেই শ্যামাদেবীর ভাই শান্তনু মুখোপাধ্যায়ই হয়ে ওঠেন স্কুলের ‘মাস্টারমশাই’ পড়ুয়ারা শান্তনুবাবুকেই ‘স্যার’ বলে ডাকেন। সোমবার শ্যামাদেবী ফোনে বলেন, ‘আমি যেতে পারছি না। অতদূর যাওয়া আসা করতে একটু সমস্যা হচ্ছে। তাই ভাইকে পাঠিয়েছি।’
শান্তনুবাবুও বিষয়টি অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘দিদির হয়ে ক্লাস করাচ্ছি দীর্ঘদিন ধরে। দিদি সুস্থ হওয়ার পর রোজই আসতে চেয়েছিল। বাড়ির লোকও বলেছিল। কিন্তু যদি অঘটন ঘটে যায়! তাই আমিই আসতে দিই না। আমি ভালো পড়াতে পারব বলেছি।’ একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, ‘গ্রামের কোনও বাসিন্দার অবশ্য এনিয়ে অভিযোগ নেই। ইন্দ্রবিল চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক ভিজিটও করে গিয়েছেন।’ গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশের বক্তব্য, ওঁর দিদি অসুস্থ। তাই মানবিকতার খাতিরে আমরা আপোষ করে নিয়েছিলাম।
স্কুল সূত্রের খবর, বছরখানেক আগে একবার স্কুলে এসেছিলেন ওই চক্রের বিদ্যালয় পরিদর্শক। বিষয়টি তাঁর নজরে আসে। কিন্তু তারপরও বুক ফুলিয়ে দিদির হয়েই প্রক্সি দিয়ে যাচ্ছেন শান্তনুবাবু। এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, শান্তনুবাবুর সঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের সখ্যের কথা। তাঁর মাথার উপর হাত রয়েছে তৃণমূলের অঞ্চল নেতৃত্বের। ফলেস বিষয়টি নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করার সাহস পাননি কেউই। এনিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক অরবিন্দ নন্দী বলেন, ‘বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ জানে। গ্রামবাসীদেরও আপত্তি নেই। আমি আর কি করতে পারি!’ ওই চক্রের বিদ্যালয় পরিদর্শক তুফান বাগদি অবশ্য ঘটনার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘এরকম কোনও ঘটনার কথা আমার জানা নেই।’ ঘটনাটি শুনে কার্যত আকাশ থেকে পড়েন জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (প্রাথমিক) প্রলয়েন্দু ভৌমিক। তিনি বলেন, ‘এভাবে কখনই স্কুল চলতে পারে না। আমি বিষয়টি আপনাদের কাছে থেকে শুনলাম। খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হবে।’