সংবাদদাতা, কাটোয়া: অষ্টাদশ শতকে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর মূর্তি তৈরি করে অবাক করে দিয়েছিলেন বাঙালি শিল্পী নবীন ভাস্কর। দীপাবলিতে আজও আঁধারে ডুবে থাকে দাঁইহাটের সেই ভাস্করের বাড়ি। শিল্পীর ভাঙা বাড়িতে পড়ে আছে কষ্টিপাথরের মহা মূল্যবান সব শিল্পকর্ম। কালের অতলতলে অবহেলায় শেষ হয়ে যেতে বসেছে শিল্পীর সেই ঘর, স্টুডিও। শিল্পীর পরিবারের সদস্যদের দাবি, ভাঙা বাড়িতে স্মৃতির উদ্দেশে কিছু একটা করা হোক, যাতে নতুন প্রজন্ম শিল্পীকে নতুনভাবে চিনতে পারে। পরিবারের সদস্যদের আক্ষেপ, দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মূর্তি তৈরি করা বিখ্যাত নবীন ভাস্করকে আজ কেউ মনে রাখেননি।
দাঁইহাট পুরসভার চেয়ারম্যান প্রদীপ রায় বলেন, দাঁইহাটের স্বনামধন্য শিল্পীর কথা আমরা ভুলে যাইনি। আমরা তাঁর স্মৃতিরক্ষায় কিছু একটা করব।
নবীন ভাস্করের বাড়ি কালের গ্রাসে অবহেলায় নষ্ট হয়ে হচ্ছে। ভাঙা বাড়ি থেকে পুরনো দিনের ইট খসে পড়ছে। অথচ এই ভাস্করই একসময় বাংলা, বিহার, ওড়িশায় শিল্পের এক জোয়ার এনে দিয়েছিলেন। দাঁইহাট শহরে বসেই একের পর এক কষ্টিপাথরের উপর খোদাই করে মূর্তি তৈরি করে অবাক করে দিয়েছিলেন তিনি।
১৮৫৫ সালে রানি রাসমণির দেওয়া বরাত পেয়ে নবীন ভাস্কর মা ভবতারিণীর মূর্তি তৈরি করেছিলেন। মাসাধিককাল ধরে কলকাতায় গিয়ে হবিষ্যান্ন খেয়ে আচার মেনে পরম ভক্তিভরে এবং নিষ্ঠা সহকারে মা ভবতারিণীর মূর্তি গড়ার কাজ নবীন ভাস্কর যখন শেষ করেছিলেন, তখন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহের মাপে মায়ের মূর্তি বেমানান হচ্ছিল। রানি রাসমণি ফের নবীন ভাস্করকে মা ভবতারিণীর মূর্তি তৈরির বরাত দেন, তবে এবার আগের মূর্তির থেকে বড় করতে বলেন। নবীন ভাস্কর মা ভবতারিণীর দু’টি মূর্তি তৈরি করেছিলেন। একটা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে আছে, অন্যটি কলকাতার গোয়াবাগানের কোনও এক বাড়িতে আছে। নবীন ভাস্করের নাতনি শ্রীরানি ভাস্কর জানান, রানি রাসমণি নাকি একটি মূর্তি তাঁর পরিচিত কাউকে দান করেছিলেন। নবীন ভাস্করের ভাস্কর্যে সে সময় বাংলা তথা ভারতের ভিন রাজ্যের রাজারাও আকৃষ্ট হয়ে দাঁইহাট এসেছিলেন। দাঁইহাট শহরের বাসিন্দা ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা অশেষ কয়াল বলেন, কাঁচামাল হিসাবে কষ্টিপাথর সংগ্রহের জন্য বিহারের জামালপুরে একটা আস্ত পাহাড় কিনেছিলেন নবীন ভাস্কর। নবীনের সুখ্যাতির জন্য বর্ধমান রাজবংশ ছাড়াও কাশিমবাজার, নাটোর, পুঁটিয়া, রংপুর, দিনাজপুর, জেমো, মুক্তগাছা, ময়মনসিং, মণিপুর, লালগড়, রাজপরিবারের কাছ থেকে তিনি গৃহদেবতা নির্মাণের বরাত পেতেন।
কথিত আছে দিনাজপুরের মহারানি নবীনের শিল্পনৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সোনার বাটালি উপহার দিয়েছিলেন। বলা হয় নবীনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি মঙ্গলকোটের ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা মূর্তি। এখনও নবীন ভাস্করের ঘরে কিছু মূর্তি পড়ে রয়েছে, যেগুলোকে শিল্পীর শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মের নির্দশন হিসাবে আগলে রেখেছেন পরিবারের সদস্যরা। বর্তমানে নবীনের শিল্পকর্মের ঘর ভেঙে আগাছায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে, নাচমহল ভেঙে পড়েছে। আছে বসতবাড়ির একটা ঘর, তাও আবার ভগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে। এত বড় ভাস্করকে এই প্রজন্ম মনে রাখেনি, এটাই আক্ষেপ তাঁর পরিবারের বর্তমান সদস্যদের। -নিজস্ব চিত্র