• রাজবলহাটের শ্বেতকালীর ‘বাহন’ দুই শিব, ছুরি আর রক্তপাত্র হাতে, রাজবল্লভীকে ঘিরে জনশ্রুতি
    বর্তমান | ৩০ অক্টোবর ২০২৪
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, চুঁচুড়া: কালী করালবদনী...। কালীর এই স্বাভাবিক চেহারার কথা বলতে গেলেই থমকে যেতে হবে। কারণ, রাজবলহাটের রাজবল্লভীকে ওই ছবির সঙ্গে মেলানো যাবে না। তিনি করালবদনীও নন, কালোও নন। তাঁর লোলজিহ্বা নেই। নেই নরমুণ্ডমালাও। রাজবল্লভী চণ্ডী, কিন্তু তাঁর অবয়ব শ্বেত অর্থাৎ সাদা। তাঁর অবয়ব স্নিগ্ধ। জনশ্রুতি, তাঁর অবয়ব নির্মাণ করা হয়েছে শরৎকালীন জ্যোৎস্নার আলোকস্নিগ্ধ করে। তাঁর রঙের মতো অবয়বও অনন্য, তর্কযোগ্যভাবে বাংলা তথা দেশের একমাত্র। তিনি দ্বিভুজা। তাঁর এক হাতে ছুরি অন্য হাতে রক্ত রাখার মালসা বা বাটি। তাঁর এক পা শিবের বুকের উপরে রাখা, অন্য পা ভাঁজ করে রাখা শিবের মাথায়।   

    অর্থাৎ তাঁর দুটি পা শিবের উপরেই স্থাপিত। যদিও হুগলি জেলার ইতিহাস গ্রন্থে সুধীরকুমার মিত্র বলেছেন, যিনি বুক পেতে দেবীর পা ধরেছেন তিনি মহাকাল ভৈরব এবং যাঁর মাথায় দেবীর পা তিনি বীরুপাক্ষ মহাদেব। এই বিবৃতি নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ, ভৈরব শিবের অবতার এবং বীরুপাক্ষ শিবের অন্যনাম। মন্দিরের ভৈরব এবং বিরূপাক্ষ একরকমই দেখতে। ফলে কেমন করে তাঁরা কালভৈরব বা বিরূপাক্ষ হলেন, তা নিয়েই চর্চার অবকাশ আছে। আবার, কেনই-বা দু’জন শিবকে দেবীর ‘বাহন’ হতে হল, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সমাধান মেলে না। 

    যেমন বেনজির তাঁর অবয়ব তেমনই বেনজির জনশ্রুতি জুড়ে আছে দেবী রাজবল্লভীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে। একদা রাজবলহাট সমৃদ্ধ পরগনা ও মহানগরী ছিল। জাঙ্গিপাড়ার ওই অঞ্চল ছিল বন্দর। এই বন্দরসংলগ্ন এলাকায় দেবী ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন। তারপর এক বণিক তাঁর রূপে মোহিত হয়ে তাঁকে অপহরণ করেন। তাতেই বণিকের ছয়টি ডিঙা বা বজরা ডুবে গিয়েছিল। সপ্তডিঙা ডোবার আগে দৈববাণী হয়। তারপরেই দেবীর কাছে ক্ষমা চেয়ে মন্দির গড়ে দেন সেই বণিক। আজও দেবীর পুজোর সময় সপ্তডিঙা ভাসানো হয়। আর-একটি জনশ্রুতি এইরকম— ভুরশুট পরগনার রাজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মজার কথা, রাজাকে স্বপ্নাদেশ দেওয়ার আগে রানির সহচরীকে প্রত্যক্ষ দর্শন দিয়েছিলেন দেবী রাজবল্লভী। তিনি তাঁর পরিচয় দিয়েছিলেন ‘গৌরীর দিদি’ বলে। 

    প্রশ্ন উঠবে, গৌরী কে? আসলে রানি, দেবী দুর্গার গৌরী রূপের পুজো করতেন।

    অনন্য এই দেবীমূর্তির প্রতিষ্ঠা নিয়ে জনশ্রুতির পাশাপাশি তার সময়কাল নিয়ে লেখাজোখা বড় গোলমেলে। তবে দু’টি স্পষ্ট হিসেব মেলে। প্রথমত, ষোড়শ শতাব্দীতে ভুরশুটের রাজা রুদ্রনারায়ণ দেবীর মন্দির নতুন করে নির্মাণ করে তাঁকে দ্বিতীয়বার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর, সমৃদ্ধ ভুরশুট পরগনার উল্লেখ মেলে আকবরের ‘আইন-ই-আকবরি’তে। তবে দেবী রাজবল্লভীর কারণেই যে জাঙ্গিপাড়ার জনপদের নাম রাজবলহাট হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যদিও জনশ্রুতি অনুসারে, দেবী নিজে তাঁর নগরের নাম দিয়েছিলেন রাজবল্লভীহাট। -নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)