• নির্যাতিতার জন্য বিচারের দাবি চেয়ে আন্দোলন এখন জুনিয়র ডাক্তারদের দুই সংগঠনের মল্লযুদ্ধের ভূমি!
    আনন্দবাজার | ৩০ অক্টোবর ২০২৪
  • আরজি কর-কাণ্ডের পরে ৮০ দিন পেরিয়ে গিয়েছে। ওই হাসপাতালে ধর্ষিতা এবং নিহত চিকিৎসকের জন্য ‘বিচার’ চেয়ে বুধবার সন্ধ্যায় সল্টলেকের মেডিক্যাল কাউন্সিল থেকে সল্টলেকেরই সিজিও-তে সিবিআইয়ের দফতর পর্যন্ত মশাল মিছিল করবেন মূল আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা। ‘মূল’, কারণ, এই আন্দোলন এখন দ্বিধাবিভক্ত। ‘মূল’, কারণ, বুধবার যাঁরা মিছিলের ডাক দিয়েছেন, এই আন্দোলন তাঁরাই শুরু করেছিলেন। যে আন্দোলন এখন পর্যবসিত হয়েছে জুনিয়র ডাক্তারদের দু’টি সংগঠনের মল্লযুদ্ধের আখড়ায়।

    সেই যুদ্ধে একটি সংগঠনের সদস্যেরা অন্য সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধে ‘থ্রেট কালচার’ বা ‘হুমকি সংস্কৃতি’ নিয়ে অভিযোগ করছেন। সেই অভিযোগের পাল্টা হুমকির অভিযোগ করা হচ্ছে। একটি সংগঠন ১০ দফা দাবি জানিয়ে মুখ্যসচিবকে ইমেল পাঠালে অন্য সংগঠন সেই সমস্ত দাবির বিরোধিতা করে পাল্টা ইমেল পাঠাচ্ছে তাদের ৮ দফা দাবি জানিয়ে!

    একটি সংগঠনের বিলম্বিত আত্মপ্রকাশের পর তাদের আহ্বায়কের সঙ্গে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ছবি প্রকাশ্যে আসছে। তার অব্যবহিত পরেই ‘মূল’ সংগঠনের নেতার সঙ্গে সন্দীপের পাল্টা ছবি প্রকাশ্যে আনা হয়েছে!

    একটি সংগঠনের নেতা প্রকাশিতব্য অন্য সংগঠনের লোকজনকে প্রকাশ্যে ‘নটোরিয়াস ক্রিমিনাল’ বলছেন। অন্য সংগঠনের নেতারা আবার পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন ‘আন্দোলনের নামে’ টাকা তোলার। দাবি উঠেছে, সেই তহবিল ‘অডিট’ করানোরও!

    যুযুধান দু’টি পক্ষ হল ‘পশ্চিমবঙ্গ জুনিয়র ডক্টর্‌স’ ফ্রন্ট’ (ডব্লিউবিজেডিএফ) এবং ‘পশ্চিমবঙ্গ জুনিয়র ডক্টর্‌স’ অ্যাসোসিয়েশন’ (ডব্লিউবিজেডিএ)। সংক্ষেপে ‘জেডিএফ’ এবং ‘জেডিএ’। দুই সংগঠনের সাম্প্রতিক তোপধ্বনিতে তরুণী চিকিৎসকের জন্য বিচার চাওয়ার বিষয়টিই কার্যত অন্তরালে চলে গিয়েছে।

    জুনিয়র ডাক্তারদের দুই সংগঠনের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপের গর্জনে আরজি করের নির্যাতিতার জন্য বিচারের দাবিতে যে ‘ইউ ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে কলকাতার রাজপথ মুখরিত হয়েছিল, যে দাবিতে ১৪ অগস্ট ‘মেয়েদের রাত দখল’ আন্দোলনে নজিরবিহীন দৃশ্য দেখেছিল কলকাতা-সহ গোটা রাজ্য, তা ক্রমশ স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। বিচারের দাবি কি তবে আর ‘মুখ্য’ নয়? মূল আন্দোলনের ‘অভিমুখ’ কি বদলে গিয়েছে? ফ্রন্টের সদস্য দেবাশিস হালদার-সহ অন্যেরা অবশ্য প্রথম থেকেই দাবি করে আসছেন, তাঁদের ১০ দফা দাবির লক্ষ্যই হল আরজি করের নির্যাতিতার জন্য ‘বিচার’ নিশ্চিত করা এবং ওই ধরনের ঘটনা যাতে আর একটিও না ঘটে, তা সুনিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর সংস্কার চাইছেন তাঁরা। দেবাশিসের সহযোদ্ধা আসফাকুল্লা নাইয়ার কথায়, ‘‘আমাদের ন্যায়বিচারের দাবি অটুট। সেই লক্ষ্যে কর্মসূচিগুলি আরও তীব্র হবে।’’ আসফাকুল্লার দাবি, ‘নতুন’ সংগঠনের অভিযোগগুলির কোনও যুক্তি নেই। তাঁদের সঙ্গে জনসমর্থন বা সিনিয়রদের সমর্থনও নেই। তাঁর কথায়, ‘‘নির্যাতিতার জন্য বিচারের দাবিতেই প্রথম থেকে আমরা রাজপথে।’’ আবার নতুন সংগঠনের আহ্বায়ক শ্রীশ চক্রবর্তীর পাল্টা দাবি, ‘‘আমরাই প্রথম থেকে ন্যায়বিচার চাইছি। তার জন্য আমরা কোনও কর্মবিরতি পালন করিনি। কাজ বন্ধ করিনি। ওরা আমাদের সরিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চায়। তাই থ্রেট কালচারের অভিযোগ এনেছে।’’

    শুরু গত ৯ অগস্ট আরজি কর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চার তলার সেমিনার হল থেকে কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসকের দেহ উদ্ধারের পর। তার পরেই হাসপাতালের নিরাপত্তা জোরদার করা তথা স্বাস্থ্য প্রশাসনে ‘পরিবর্তন’ আনতে চেয়ে পথে নামেন জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশ। সারা রাজ্যের জুনিয়র ডাক্তারদের একটি অংশকে নিয়ে তৈরি হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ জুনিয়র ডক্টর্‌স’ ফ্রন্ট’ (ডব্লিউবিজেডিএফ)। যার মূল দাবি ছিল আরজি করের নির্যাতিতার জন্য বিচার। যা এখন সিবিআইয়ের তদন্তাধীন। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা প্রাথমিক চার্জশিটও দিয়েছে। যে চার্জশিট আন্দোলনকারীদের ‘পছন্দ’ হয়নি বলে তাঁরা প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন। গত আড়াই মাসে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে একে একে জোরদার হয়েছে হাসপাতালগুলিতে প্রচলিত ‘হুমকি সংস্কৃতি’, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে কারচুপি এবং দুর্নীতির অভিযোগ। চলতে থাকে কর্মবিরতিও।

    প্রথমে স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থা এবং তার পরে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে আংশিক কর্মবিরতি ওঠে। কারণ, সেই বৈঠকে আন্দোলনকারীদের অধিকাংশ দাবিই মেনে নেওয়া হয়েছিল। তার পর সাগর দত্ত হাসপাতালে ডাক্তার নিগ্রহের ঘটনার পরে আরজি করের ঘটনার বিচার-সহ ১০ দফা দাবিতে ‘আমরণ অনশন’ শুরু করেন জেডিএফ-এর সদস্যেরা। ‘আমরণ অনশন’ শুরু হয় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজেও। ১৭ দিন ধরে সেই অনশন আন্দোলন চলার পরে আবার আলোচনায় বসেন মুখ্যমন্ত্রী। ১০ দফা দাবির সিংহভাগ মেনে নেয় সরকার। অনশন ওঠে। তবে আন্দোলনকারীরা জানান, ‘থ্রেট কালচারে’ অভিযুক্তদের শাস্তি-সহ বিভিন্ন দাবিতে তাঁদের আন্দোলন চলবে।

    জেডিএফ-এর পাল্টা সংগঠন হিসাবে তৈরি হয় জেডিএ। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের কিছুদিন পরেই এই সংগঠন প্রকাশ্যে আসে। মূলত যাঁদের বিরুদ্ধে ‘থ্রেট কালচারে’ যুক্ত থাকার অভিযোগ এনেছিল প্রথম পক্ষ, তাঁরাই এই পাল্টা সংগঠনের হোতা। যাঁদের বক্তব্য, আন্দোলনের নামে জুনিয়র ডাক্তারদের একটি অংশ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ‘অরাজকতা’ তৈরি করতে চাইছে। যাঁরা চিকিৎসা পরিষেবা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়ার ‘অসত্য’ অভিযোগ করা হচ্ছে।

    এই কুস্তির মধ্যেই ময়দানে নেমেছে জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন ‘প্রোগ্রেসিভ জুনিয়র ডক্টর্‌স’ অ্যাসোসিয়েশন’ (পিজেডিএ)। তাদের দাবি, তারাই ‘আসল’ সরকারপন্থী সংগঠন। তাদের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, তারা জেডিএ-র বিরোধী। জেডিএ আপাতদৃষ্টিতে ‘অরাজনৈতিক’ হলেও তাদের নেপথ্যে যে শাসক তৃণমূল ছিল, তাতে বিশেষ লুকোছাপা ছিল না। তার পরেই আসরে নেমেছে ‘সরকারপন্থী’ পিজেডিএ। তাদের দাবি, তারা জেডিএফ-এর সঙ্গে রয়েছে। যদিও জেডিএফ এই সংগঠনের মনোভাব নিয়ে ‘সন্দিহান’। হাসপাতাল-রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালদের অনেকের বক্তব্য, নবতম সংগঠনটি শাসক তৃণমূলের অন্দরের রাজনৈতিক সমীকরণের ফল। আরজি কর হাসপাতালে যার ‘ছায়া’ রয়েছে। সেই কারণেই তারা ‘দ্বিতীয়’ সংগঠনের বিরোধিতা করে ‘প্রথম’ সংগঠনের পাশে থাকতে চাইছে। যদিও এর পাল্টা অভিমতও রয়েছে। যাঁরা মনে করছেন, তৃতীয় এই সংগঠন ‘সরকারপন্থী’ হওয়ায় তাদের দাবিদাওয়া স্বাস্থ্য প্রশাসনের কাছে ‘গুরুত্ব’ পাবে। তবে যা নিয়ে দ্বিমত নেই— এই অনুপ্রবেশের ফলে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য-বিধেয় আরও ঘোলাটে হয়ে পড়বে।

  • Link to this news (আনন্দবাজার)