তারাপীঠে শোল মাছ ছাড়া পুজো হয় না, কালীঘাট -দক্ষিণেশ্বরে ভোগে মা-কে কী কী খেতে দেওয়া হয়?
আজ তক | ৩০ অক্টোবর ২০২৪
বৃহস্পতিবার কালীপুজো, শক্তির আরাধনা করতে প্রস্তুত হচ্ছেন ভক্তরা। কালীপুজোয় মেতে উঠতে উন্মাদনায় টগবগিয়ে ফুটছে বাংলা। কালীপুজো নিয়ে উৎসাহ এখন গোটা রাজ্যে। এই দিন মা কালীর আরাধনায় ব্রতী হন সকলে। কালীপুজোর দিন মায়ের ভোগের থালায় থাকে নিরামিষ-আমিষ নানা পদ।
প্রসঙ্গত কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপুজো বিশেষ জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়। কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত কালীমন্দিরটি হল কালীঘাট মন্দির। এটি একটি সতীপীঠ। এছাড়া দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি, আদ্যাপীঠ, ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি, ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি ইত্যাদি কলকাতা অঞ্চলের বিখ্যাত কয়েকটি কালী মন্দির। শান্তিনিকেতনের কাছে কংকালিতলা, কালনার সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি, তারাপীঠ এর কালীমন্দির, জয়নগরের ময়দা কালীবাড়ি ও ধন্বন্তরি কালীবাড়ি, হালিশহরের রামপ্রসাদী কালী মন্দির ইত্যাদি হল পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কয়েকটি কালীমন্দির। এছাড়া আসামে কামাখ্যা, ত্রিপুরাতে ত্রিপুরেশ্বরী কালীমন্দির সতীপিঠ ও বিশেষ জনপ্রিয় কালী মন্দির, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে অবস্থিত রমনা কালীমন্দির খুবই প্রাচীন একটি কালীমন্দির। চট্টেশ্বরী কালী মন্দির ও ৫১ শক্তিপীঠের একটি। ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লির নতুন দিল্লি কালীবাড়ি একটি ঐতিহ্যপূর্ণ কালীমন্দির। বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় প্রায় চারশ বছরের পুরনো বার্থী তাঁরা মায়ের মন্দির রয়েছে। কালী পুজোর সময় মায়ের যে ভোগ হয় তা অন্যান্য পুজোর থেকে বেশকিছুটা আলাদা। স্থান বিশেষে নিরামিষ ভোগের সঙ্গে মায়ের পুজোতে আমিষ ভোগও থাকে। নিরামিষ ভোগের মধ্যে যেমন থাকে অন্ন ভোগ, পোলাও ভোগ – সাদা ভাত, খিচুড়ি, শুক্ত, শাক, ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, পাঁচমিশালী তরকারি, আলু পটোলের তরকারি, ফুলকপির তরকারি, লুচি, ছানার তরকারি, খেজুরের চাটনি, পায়েস, মিষ্টি ৷ আমিষ ভোগে কালীকে নিবেদন করা হয় যেকোনও আঁশযুক্ত মাছ রুই মাছ, কাতলা মাছ, ইলিশমাছ, চুনো মাছের টক, পোড়া শোলমাছ মাখা আর পিয়াঁজ রসুন ছাড়া নিরামিষ কচি পাঁঠার মাংস ৷ প্রাচীন রীতি মেনেই ভোগ রান্না হয়ে থাকে রাজ্যের তিন অন্যতম কালীতীর্থে। দক্ষিণেশ্বর, কালিঘাট এবং তারাপীঠের মতো কালীতীর্থে যাবতীয় রীতিনীতি মেনেই পুজো এবং ভোগ নিবেদন করা হয়।
জানেন কি, দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী থেকে আদ্যাশক্তি কালী বা তারা মা– রাজ্যের নানা প্রান্তে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা কালীক্ষেত্রগুলিতে কী কী নিবেদন করা হয় ভোগ হিসেবে?
তারাপীঠ
সারা বছর বহু মানুষ ভিড় করেন তারাপীঠে। দেবী এখানে মা তারা রূপে পূজিত হন। সারা বছর নানা ব্যঞ্জন সাজিয়ে নিবেদন করা হয় মা'কে। কালী পুজোর দিনেও থাকে বিশাল আয়োজন। সকালে নিবেদন করা হয় অন্নভোগ। কালী পুজোর দিন খুব সকালে ডাবের জল দিয়ে শুরু হয় মায়ের ভোগ। সকালের ভোগে থাকে পাঁচ রকম বা ন’রকমের ভাজা, সাদা অন্ন, পায়েস ও মিষ্টি। কখনও ফ্রায়েড রাইস। এই একই ভোগের আয়োজন থাকে শ্মশান কালীর জন্যও। আমিষ ভোগের মূল উপাদান হল শোল মাছ। ভোগের পাতে এই মাছ না থাকলে ভোগ গ্রহণ করেন না মা তারা। বলি-দেওয়া পাঁঠার মাংস। সঙ্গে পাত্রে থাকে কারণবারি। মন্দির কর্তৃপক্ষ যেমন ভোগ নিবেদন করেন, তেমনই ভক্তরাও তাঁদের ইচ্ছেমতো সবজি,মাছ, মাংসের ভোগ নিবেদন করেন তারা মাকে। তারা মায়ের যে ভাবে ভোগ পুজো হয়, সেই একই ভাবে পুজো করা হয় শ্মশান কালীকে। শ্মশানেই রয়েছে মায়ের আসল শিলা পাদুকা। তার পাশে বামদেবের সমাধি। তারাপীঠের নিয়ম অনুযায়ী সন্তানকে খাইয়ে তবেই তারা মা ভোগ গ্রহণ করেন। তাই বামদেবের ভোগ আগে দেওয়া হয়। ভোগের তালিকায় রয়েছে প্রেত ভোগও। ডাকিনী যোগিনীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া এই ভোগ শ্মশানেই দেওয়া হয়। রাতে এক বারই এই ভোগ আয়োজন থাকে। বামদেবের খুব প্রিয় কুকুর ছিল শিবা। তার জন্যও থাকে বিশেষ ভোগের আয়োজন।
দক্ষিণেশ্বর
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের মা ভবতারিণীর ভোগে যদিও মাংসের কোনও আয়োজন থাকে না। কারণ বলি প্রথা এখানে নিষিদ্ধ। পুজোয় সুরারও কোনও স্থান নেই। নারকেল ফাটিয়ে, সেই নারকেলের জল দেওয়া হয় মাকে। এই মন্দিরে নিত্যদিন কোনও সেবায়েতের পালা পড়ারও ব্যবস্থা নেই। পুজোয় মায়ের ভোগের নিত্যদিনের আয়োজন মন্দির কমিটিই করে থাকেন। কালীপুজোয় অন্যান্য বছরে অন্তত হাজার দশেক ভক্তের ভোগের আয়োজন করা হয়। কালীপুজোর দিন প্রতি বছরের মতোই মা সেজে ওঠেন বেনারসি পরনে। সোনার অলঙ্কারে। কালীপুজোর দিন মায়ের অন্নভোগে থাকে ভাত, ঘি-ভাত, পাঁচ রকমের ভাজা, পাঁচ রকমের তরকারি, পাঁচ রকমের মাছ। সেই সঙ্গে ভোগে থাকে চাটনি-পায়েস, পাঁচ রকমের মিষ্টি-জল। শ্রীরামকৃষ্ণের দেখানো পথেই মা কালী পুজিত হন দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে। কালীপুজোর দিনে মায়ের যে বিশেষ আরতি, এই পুজোর এক দারুণ আকর্ষণ।
কালীঘাট
কালীঘাটে দুপুর দু'টো নাগাদ মাকে দেওয়া হবে অন্নভোগ। তাতে থাকবে পোলাও-ঘি ভাত-শুক্তো, আলু-বেগুন-পটল-উচ্ছে-কাঁচকলা দিয়ে পাঁচ রকমের ভাজা, পোনা-চিংড়ি মাছ, খেজুর-কাজু-কিশমিশ দিয়ে চাটনি, পায়েস-পান-জল। আর সেই সঙ্গে প্রথম বলির পাঁঠার মাংস। সেই মায়ের ভোগই মাটির হাঁড়ি করে বিতরণ করা হবে ভক্তদের। যদিও রাতে লক্ষ্মীরূপী মাকে ভোগ নিবেদন করা হয় নিরামিষ। সেই শীতল ভোগের আয়োজনে থাকবে ময়দার লুচি, খিচুড়ি-তরকারি, দু-তিন রকমের ভাজা, রাবড়ি-রসগোল্লা-দই-মিষ্টি-পান-জল। লক্ষ্মীপুজো শেষ হলে, পাটকাঠিতে আগুন ধরিয়ে প্রদক্ষিণ করা হবে মায়ের মন্দির। এ দিন খড় দিয়ে তৈরি করা হয় লক্ষ্মীর আদলে এক 'অলক্ষ্মী'-র মূর্তি। সেই মূর্তিতে আগুন ধরিয়ে বিদায় জানানো হয় অলক্ষ্মীকে। তারপর বিতরণ করা হয় লক্ষ্মীপুজোর প্রসাদ।
কঙ্কালীতলা
বোলপুরে কোপাই নদীর তীরে কঙ্কালীতলা মন্দির। সতী পীঠের অন্যতম এই পীঠে মায়ের কাঁকাল, অর্থাৎ কোমরের হাড় পড়েছিল বলে কথিত। আবার ৫১ পীঠের শেষ পীঠ হল কঙ্কালীতলা। এখানে মহাকালী রূপে পূজিত হন মা। দুপুরে অন্ন ভোগে মাকে দেওয়া হয় পাঁচ রকমের ভাজা, ডাল, ফ্রায়েড রাইস, বাঁধাকপির তরকারি, চাটনি ও পায়েস। কালীপুজোর দিন দু’বার ভোগ দেওয়া হয়। দুপুরে নিরামিষ ভোগ, আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয় রাতে।
ঠনঠনিয়া কালী বাড়ি
কলকাতার অন্যতম প্রাচীন কালী মন্দির হল ঠনঠনিয়া কালী বাড়ি। বিধানসরণির উপরে কলেজস্ট্রীটের কাছে এই মন্দিরে সারা বছর ঘটে ভক্ত সমাগম। জাগ্রত বলে পরিচিত এই কালী মন্দিরে তাই সারা বছর মনবাঞ্ছা পূরণের আশায় ছুটে আসেন মানুষজন। শোনা যায়, ১৭০৩ খ্রীস্টাব্দে সাধক উদয় নারায়ণ ব্রহ্মচারীর হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় এই কালী মন্দিরের। উদয় নারায়ণ নিজে একজন তান্ত্রিক ছিলেন। তিনি নিজের হাতে করে গড়ে তোলেন ঠনঠনিয়া কালী বাড়ির মাতৃ মূর্তি। মা এখানে পূজিত হন সিদ্ধেশ্বরী রূপে। পুজোতেও আছে বিশেষ নিয়ম। এমনিতে সারা বছর আমিষ ভোগের চল এই পুজোয়। তবে, ফলহারিণী ও দীপান্বিতা কালী পুজোয় নিবেদন করা হয় নিরামিষ ভোগ।