বস্তুত, আবাস যোজনার তালিকা প্রস্তুত করা নিয়ে জেলায় জেলায় নতুন করে শুরু হয়েছে বিতর্ক। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন, কেন্দ্রের শর্তে নয়, আবাস যোজনায় বাড়ির জন্য আর্থিক সাহায্যের ক্ষেত্রে ‘মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি’ থাকতে হবে। নবান্নের তরফে জারি হয়েছে নতুন নির্দেশিকাও। সেখানে বলা হয়েছে, বাদ যাওয়া নামগুলি পুনর্বিবেচনার জন্য তথ্যযাচাই হবে। কিন্তু তার মধ্যেও অভিযোগ অন্তহীন। শাসকদলের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা। শাসকদলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ঘুরপথে আবাসের ঘর পাইয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে জেলায় জেলায়। তালিকায় নাম রাখতে সমীক্ষা চলাকালীন পাকা বাড়ি ছেড়ে অস্থায়ী ভাবে গোয়াল ঘরে বাস করারও অভিযোগ পর্যন্ত সামনে এসেছে।
এই প্রেক্ষিতে বুধবার দুপুরে নবান্নে বৈঠকে বসেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। ভিডিয়ো কনফারেন্সে প্রত্য়েক জেলাশাসককে এ ব্যাপারে মানবিক ভিত্তিতে সার্ভে করার নির্দেশ দেন তিনি। আলাপন বলেন, ‘‘আবাস যোজনা প্রকল্পে কেন্দ্রের ৬০ শতাংশ অর্থ দেওয়ার কথা। দিল্লি সেই টাকা দেয়নি। তাই গরিব মানুষগুলোর স্বার্থে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাড়িগুলো তৈরির জন্য টাকা রাজ্যই দেবে। সেই কারণেই সমীক্ষা শুরু হয়েছে।’’ আলাপন আরও বলেন, ‘‘কেউ পাকাপাকি বাড়ি করে ফেলেছেন কি না, অন্যত্র চলে গিয়েছেন কি না তা দেখতেও এই সমীক্ষা। ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক মানুষের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সকল তালিকাভুক্ত মানুষ মাথা পিছু এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা পাবেন। অহেতুক এই রি-সার্ভে নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই।’’
অন্য দিকে, বুধবারও দিকে দিকে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। নানাবিধ ফন্দিফিকির করে সরকারি আবাসের সুবিধা নেওয়ার অভিযোগের মধ্যে ‘অন্য ছবি’ দেখা গেল শুধু মুর্শিদাবাদের জলঙ্গিতে। সেখানে আবাস যোজনার তালিকায় নিজের নাম বাদ দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছেন তৃণমূলের এক অঞ্চল সভাপতি। চোয়াপাড়ার কীর্তনিয়াপাড়ায় নিজের পাকাবাড়ি রয়েছে বলে তাঁর এই সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছেন মাসাদুল মণ্ডল।
উপনির্বাচনের কারণে রাজ্যের পাঁচ জেলা বাদে সর্বত্র আবাস যোজনার চূড়ান্ত পর্যায়ের সমীক্ষা শুরু হয়েছে। সমীক্ষার সময়ে তালিকায় নাম থাকা উপভোক্তাদের তাঁদের বর্তমান বাড়ির সামনে সশরীরে উপস্থিতি থাকা বাধ্যতামূলক। কারণ, উপভোক্তার ছবি, তাঁর বাড়ির ছবি নির্দিষ্ট পোর্টালে আপলোড করা হচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে অসুবিধা হতে পারে ভেবে রাজ্য জানিয়েছে, কর্মসূত্রে এখন যাঁরা বাইরে রয়েছেন, সমীক্ষার জন্য তাঁদের কোনও নিকট আত্মীয় উপস্থিত থাকলেই হবে। তবে দ্বিতীয় দফার ভেরিফিকেশনের সময়ে ওই পরিযায়ী শ্রমিককে উপস্থিত থাকতেই হবে। কিন্তু ওই সমীক্ষার শুরুতেই জায়গায় জায়গায় শুরু হয়েছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ। নেতা, বিধায়ক থেকে মন্ত্রীকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে জলঙ্গির তৃণমূল নেতা মাসদুল বলেন, ‘‘২০১৮ সালে আবাস যোজনায় তালিকায় আমার নাম রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আমার পাকা বাড়ি রয়েছে। আমার আর বাড়ির প্রয়োজন নেই। তাই তালিকা থেকে নাম কেটে দিতে বলেছি। আমি চাই, আমার জায়গায় অন্য কেউ ঘর পাক।’’
যদিও স্থানীয় বাম নেতৃত্বের অভিযোগ, ওই তৃণমূল অঞ্চল সভাপতির বিরুদ্ধে অতীতে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তাই ‘নাটক’ করছেন তৃণমূল নেতা। সিপিএমের মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘তৃণমূল নেতারা ছোটখাটো কাটমানি নিয়ে এখন আর ভাবছেন না। অঞ্চল সভাপতিরা এখন লক্ষে নয় কোটিতে খেলছেন।’’
তবে মাসদুলের কাজের প্রশংসাই করেছেন জয়েন্ট বিডিও। তিনি বলেন, ‘‘উনি এক জন দায়িত্বশীল নাগরিকের মতোই কর্তব্য পালন করেছেন।’’
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় সমতল এলাকার উপভোক্তার জন্য দু’দফায় মোট ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। পাহাড়, আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দারা পান ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা। কেন্দ্রের নির্দেশিকায় রয়েছে, যে সমস্ত পরিবার পাকা ঘর এবং পাকা দেওয়ালের মধ্যে থাকে এবং দু’টির বেশি ঘর রয়েছে, সেই সব পরিবারের নাম প্রকল্প থেকে বাদ যাবে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন গ্রামাঞ্চলে আবাস যোজনার বাড়ি বিলিতে রাজ্য হবে ‘মানবিক’। কোনও ভাবেই সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের সুবিধা থেকে গরিব মানুষকে বঞ্চিত করা যাবে না। মঙ্গলবার নবান্নে পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার ও কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী ওই নির্দেশ দেন। ঘূর্ণিঝড় ‘ডেনা’য় ক্ষয়ক্ষতি প্রসঙ্গে মমতা জানিয়েছেন, সকল ক্ষতিগ্রস্তের পাশে থাকতে হবে। বাড়ির জন্য অর্থ বিলির সময় যেন মানবিক ভাবে বিচার করা হয়।
যার প্রেক্ষিতে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, প্রকৃত উপভোক্তারা সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘‘আবাস যোজনার তালিকা ভুলে ভরা। ১৭টি দল পাঠিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। তাতে দেখা গিয়েছে, অযোগ্যরা আবাসের টাকা পেয়েছেন, যোগ্যরা পাননি।’’
এরই মধ্যে নবান্ন নতুন নির্দেশিকা জারি করে। তাতে বলা হয়েছে, আবাস যোজনা থেকে কোনও যোগ্য প্রার্থীর নাম যেন বাদ না যায়। জেলা প্রশাসনকে পুনর্বিবেচনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিতর্ক এবং বিক্ষোভ থেমে নেই। বীরভূমে যেমন বিজেপি করার ‘অপরাধে’ আবাস প্রকল্পের উপভোক্তার তালিকায় নাম নেই বলে অভিযোগ করেছেন প্রচুর মানুষ। তাঁরা রামপুরহাট-২ ব্লকের বিডিও অফিসের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। বীরভূমের তারাপীঠ থানার সাহাপুর এবং বুধিগ্রাম পঞ্চায়েতের বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় দেড়শো পরিবারের দাবি, তারা বিজেপিকে সমর্থন করে বলে বঞ্চিত হয়েছে। এ নিয়ে বিডিও-র কাছে একটি স্মারকলিপিও জমা দেন বিক্ষোভকারীরা।
অন্য দিকে, বুধবার পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার পাঁচরোলে আবাস যোজনার সমীক্ষক দলকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান একদল মানুষ। উভয় পক্ষের কথা কাটাকাটি হয়। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যেরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। বুধবার দুপুরে মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুর-২ ব্লকেও উত্তেজনা দেখা গিয়েছে। আলিপুরদুয়ারের কুমারগ্রামে বাংলা আবাস যোজনার তালিকায় কুমারগঞ্জের একটি আদিবাসী পাড়ার চুয়াল্লিশটি পরিবারের এক জনেরও নাম ওঠেনি বলে অভিযোগ। স্থানীয়দের অভিযোগ, এলাকার বেশির ভাগ পরিবারই দরিদ্র। নিজের ঘরটুকুও নেই অনেকের। বিজেপির অভিযোগ, শেষ লোকসভা এবং পঞ্চায়েত ভোটে সংশ্লিষ্ট এলাকায় তাদের দলের প্রতিনিধি থাকাতেই এই কাজ করেছে শাসকদল।