• সালিশির ডান্ডায় এলাকা দখল জেসিবি-দের
    আনন্দবাজার | ৩১ অক্টোবর ২০২৪
  • ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, এক জোড়া যুবক-যুবতীকে বেধড়ক মারছে এক বলশালী। কখনও হাতে মারছে। কখনও লাথি। কখনও বাঁশের কঞ্চি দিয়ে। পুরো ঘটনা ঘিরে ধরে দেখছে জনতা। কিছু বলছে না। এই ভিডিয়োটি প্রকাশ্যে আসার পরেই হইচই শুরু হয়ে যায় উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায়। ঘটনার ‘নায়ক’ তাজিমুল ইসলামকে পাকড়াও করে পুলিশ।

    কিন্তু তাজিমুল তো একা নয়, এমন দাদার সংখ্যা উত্তর থেকে দক্ষিণ, অনেক। কারও আধিপত্য উত্তর দিনাজপুরের গঞ্জে তো কারও উত্তর ২৪ পরগনার আড়িয়াদহ অঞ্চলে। চেহারার বিশালত্বের জন্য তাজিমুল এলাকায় পরিচিত ছিল ‘জেসিবি’ নামে। আর আড়িয়াদহের জয়ন্ত সিংহ হয়ে গিয়েছিল ‘জায়ান্ট’। নাম কি আর এমনি হয়! এলাকায় কান পাতলেই শোনা যায়, এই নাম বহন করে আনে ‘জায়ান্ট’ বা প্রবল দাদাগিরির কাহিনি।

    এবং এই সব দাদার পিছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সন্ধান মেলে এলাকার নেতার (এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগই শাসক দলের) পৃষ্ঠপোষকতার।

    বিরোধীদের দাবি, গ্রামে-গ্রামে শাসক দলের মদতেই তৈরি হয়েছে এমন সব দাদা। ফুটপাত দখল থেকে বেআইনি নির্মাণ, অটো-টোটোর ইউনিয়নে ছড়ি ঘোরানো থেকে সরকারি জায়গায় দোকান বসানো— সবেতেই দাদাদের দাপটের অভিযোগ। তৃণমূলের নেতাদের দাবি, তাঁরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছেন না। কেউ অন্যায় করে থাকলে পুলিশ-প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।

    সেই সূত্রেই নাম উঠে আসে তাজিমুলের। কেন যুগলকে রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছিল সে? কেনই বা আশপাশের লোকজন প্রতিবাদ করেনি? এলাকার বড় অংশ জানাচ্ছে, এর বড় কারণ, সালিশি সভা। এলাকায় সালিশির মাধ্যমে এ ভাবেই ‘বিচারব্যবস্থা’ কায়েম রাখত তাজিমুল। ভয়ে চুপ করে থাকতেন বেশির ভাগ মানুষ। সে দিনও তেমনই ঘটেছিল।

    দীর্ঘ দিন ধরে তৃণমূলের মধ্যে ‘সম্পদ’ হিসেবে পরিচিত ছিল তাজিমুল। বিরোধীদের দাবি, তাকে ব্যবহার করে এলাকায় শাসন বজায় রাখতেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা। তৃণমূল সেই দাবি দৃঢ় ভাবে অস্বীকার করেছে ঠিকই, কিন্তু দলের মধ্যেই তাজিমুলকে নিয়ে অসন্তোষ ছিল। প্রশ্ন উঠেছে, ওই ভিডিয়ো যে তেমনই কোনও ‘অসন্তুষ্ট’ কর্মী ছড়াননি, তা কে বলতে পারে!

    তাজিমুল সূত্রে উঠে এসেছে সালিশি সভার প্রসঙ্গও। বস্তুত, সালিশি সভা ‘দাদাতন্ত্রের’ এক অন্য উঠোন। এখনও গ্রাম্য বিবাদ থেকে শুরু করে পারিবারিক ও সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণ দেখিয়ে সালিশির দাপট রয়েছে। সেখানে দাদাদের দাপট সাংঘাতিক বলে অভিযোগ। তাদের মুখের উপরে কথা বলার সাহস নেই কারও।

    দাদাতন্ত্রের অভিযোগ রয়েছে কোচবিহারেও। দিনহাটায় তো খোদ উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ-কেই ‘দাদা’ বলে চিহ্নিত করেন বিরোধীরা। বলা হয়, মন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া, ওই বিধানসভায় কোনও কাজ করার অনুমতি কারও নেই। উদয়ন অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দেন। দিনহাটা থেকে তুফানগঞ্জ বা মাথাভাঙাতেও এই দাদাদের দাপট রয়েছে।

    জলপাইগুড়ি জেলা তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর বিবাদে আড়াই দিন ধরে বন্ধ হয়ে ছিল জলপাইগুড়ির মোহিতনগরের একটি বহুজাতিক সিমেন্ট কারখানার উৎপাদন। অভিযোগ, তৃণমূল নেতা কৃষ্ণ দাসের দাদাগিরিতেই বন্ধ হয়ে ছিল উৎপাদন। বোনাসের দাবিতে কারখানার গেট বন্ধ করে দিয়েছিলেন কৃষ্ণ দাসের অনুগামীরা। পরে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে কারখানা স্বাভাবিক হয়। জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েতে কৃষ্ণ দাসের দাদাগিরি চলে বলে অভিযোগ। সম্প্রতি একটি জমি দখলের মামলা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। দল পাশে নেই জানালেও কৃষ্ণ প্রকাশ্যেই দাবি করেন, তিনি জমি নিয়ে সালিশি করেছিলেন।

    দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায় এমন ‘দাদাগিরি’র উদাহরণ বিস্তর। সেই তালিকায় প্রথমে রয়েছে জয়ন্ত সিংহের নাম। আড়িয়াদহের ‘জায়ান্ট’। তার ‘দাদাগিরি’র একের পর এক তথ্য সামনে এসেছে। জমি জবরদখলের অভিযোগ থেকে শুরু করে তোলা আদায়, সালিশির নামে মারধর— কী নেই অভিযোগের তালিকায়! অভিযোগ, তার দাপটে এলাকার লোকজন সিঁটিয়ে থাকতেন। তৃণমূলের একাংশও তার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত বলেও খবর। সেই জয়ন্ত ওরফে জায়ান্ট জেল থেকে বার হওয়ার পরে কী করবে, তা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে এলাকায়।

    জয়ন্ত একা নয়, এমন দাদা ছড়িয়ে আছে আরও নানা তল্লাটে।

  • Link to this news (আনন্দবাজার)