আরজি করের ঘটনার পর কলকাতা-সহ জেলার শহর, মফস্সলে যে ‘দলহীন’ গণ আন্দোলন দেখা গিয়েছিল, তাতে ‘উদ্বেগ’ তৈরি হয়েছিল শাসক তৃণমূলের অন্দরে। সেই উদ্বেগের সঙ্গে মিশেছিল শঙ্কাও। যেমন দলের এক সাংসদ বলেছিলেন, তিনি বাড়ি থেকেই বেরোচ্ছেন না। অন্য এক সাংসদ একান্ত আলোচনায় জানিয়েছিলেন, তিনি ১৪ অগস্ট ‘মেয়েদের রাত দখল’ আন্দোলনে শামিল হতে চেয়েছিলেন। যেতে পারেননি। পাছে কটূক্তি হজম করতে হয়!
যাঁরা সেই ‘কঠিন’ সময়ে লাগাতার মুখ খুলেছিলেন, তাঁদের অন্যতম তৃণমূলের দুই মুখপাত্র কুণাল ঘোষ এবং অরূপ চক্রবর্তী। কলকাতায় বসে যখন কুণাল-অরূপেরা একসুরে পাল্টা আক্রমণ করে গিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের নেপথ্যে বাম এবং অতি বামেরা আছে বলে, তখন জেলা থেকে কখনও তাল ঠুকেছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কখনও উদয়ন গুহ। সেই পরিস্থিতির এখন কিছুটা বদল ঘটেছে। তাই জুনিয়র ডাক্তারদের খোলাখুলি আক্রমণে নেমেছেন সৌগত রায়, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়েরা।
কেন এত দিন তাঁরা মুখ খোলেননি, তার একটা ব্যাখ্যা দলীয় স্তরে অবশ্য পাওয়া গিয়েছে। এক নেতার কথায়, ‘‘আরজি করের নির্যাতিতার বাড়ি সৌগত রায়ের দমদম লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে। আবার শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় তার পাশের খড়দহের বিধায়ক। ফলে তাঁরা আন্দোলনের বিরোধী কথা বললে অন্য প্রতিক্রিয়া হতে পারত। সম্ভবত সে কারণেই তাঁরা এত দিন নীরব ছিলেন।’’
ঘটনাচক্রে, জুনিয়র ডাক্তারেরা ‘আমরণ অনশন’ প্রত্যাহার করার পর দিনই সুর চড়িয়েছিলেন সৌগত। বলেছিলেন, ‘‘এঁরা কেউ যতীন দাস, মহাত্মা গান্ধী নন। এঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নন যে, আমরণ অনশন করবেন! পাঁচ দিন অনশন করতে না করতেই এঁদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।’’ আর শোভনদেব তির ছুড়েছেন আন্দোলনের জন্য অর্থের সংস্থান নিয়ে। তাঁর কথায়, ‘‘কোথা থেকে আসছে এই টাকা? ডাক্তারবাবুরা এত টাকা পাচ্ছেন কোথা থেকে? আন্দোলনের নামে আপনারা কী করছেন?’’ বস্তুত, আরও এক ধাপ এগিয়ে প্রবীণ তৃণমূল নেতা বলেছেন, ডাক্তারদের সঙ্গে সরকারি হাসপাতালের দালালদের ‘যোগসাজশ’-এর অভিযোগ তুলে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘হাসপাতালে চারদিকে দালাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। লাইনে গেলে সিট পাবেন না। ৫০ হাজার টাকা দিলে তবেই সিট পাবেন। আমার বাড়ি পিজি হাসপাতালের পাশেই। মমতারও বাড়ি। একশো থেকে দেড়শো দালাল ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই হাসপাতালে। তারা টাকার বিনিময়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। ডাক্তারদের বেশি টাকা দেবে। তারাও কিছু রাখবে। এই তো ডাক্তারদের চরিত্র!’’
তবে তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, ডাক্তারদের সঙ্গে দালালদের ‘যোগসাজশ’-এর অভিযোগ করতে গিয়ে পরোক্ষে রাজ্যের প্রবীণ মন্ত্রী শোভনদেব মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকেই আঙুল তুলে দিয়েছেন। কারণ, তিনি বলেছেন, মমতার বাড়ির পাশের এসএসকেএম হাসপাতালে একশো-দেড়শো দালাল ঘুরছে!
একই সঙ্গে শোভনদেবের কথায় এটাও স্পষ্ট যে, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে তিনি আর এখন ততটা ‘আমল’ দিচ্ছেন না। কারণ, তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই ডাক্তারবাবুরা আন্দোলন করে আমাদের কত শিক্ষা দেবে? রাত দখল, দিন দখল, দুপুর দখল— কত কিছু দখল হয়ে গেল! আজ মানুষ বুঝতে পেরে গিয়েছে, ডাক্তারবাবুরা কোটি কোটি টাকা রোজগার করছে।’’ প্রসঙ্গত, আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের ‘তহবিল’ নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে প্রশ্ন তোলা শুরু হয়েছে। কল্যাণ যেমন আগেই বলেছিলেন, ‘‘কী এমন আন্দোলন যে, পাঁচ কোটি টাকা তুলতে হয়? এরা কোনও দিন ক্ষমতায় এলে তো দেশটাই বেচে দেবে!’’
আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের ‘পাল্টা’ সংগঠন ওই তহবিল অডিট করানোর দাবি নিয়ে মুখ্যসচিবকে ইমেল করেছে। যদিও আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, তাঁদের ওই তহবিল সম্পূর্ণ ‘স্বচ্ছ’। প্রয়োজনে তাঁরা যে কাউকে বিস্তারিত হিসাব দিতেও প্রস্তুত।
কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, আন্দোলনের ‘তীব্রতা’ কমেছে। আরজি করের ঘটনার পর প্রায় তিন মাস কেটেছে। সিবিআই তদন্ত করে প্রাথমিক চার্জশিট জমা দিয়েছে। তাতে ‘গণধর্ষণ’-এর কথা বলা হয়নি। যে অভিযুক্তকে কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, প্রাথমিক ভাবে তাঁর কথাই চার্জশিটে রয়েছে। তাতে ‘জোর’ পেয়েছে শাসক শিবির। তৃণমূলের অন্দরের খবর, সিবিআইয়ের চার্জশিট, নাগরিক আন্দোলন ‘স্তিমিত’ হওয়া এবং অনশন তুলে নেওয়ার পর থেকেই ‘পাল্টা আক্রমণ’ আরও জোরালো করার নীতি নেওয়া হয়েছে। শাসকদল মনে করছে, গণ আন্দোলনের জেরে তাদের তথা সরকারের ভাবমূর্তিতে যে ‘ক্ষত’ সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে প্রলেপ দেওয়ার এটাই সময়। রাজ্যের এক মন্ত্রীর কথায়, ‘‘সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিকূলতা একটু একটু করে কাটছিল। তাই তখন থেকেই পাল্টা বক্তব্য বলা শুরু হয়েছে। ইংরেজিতে বলে, অফেন্স ইজ় দ্য বেস্ট ডিফেন্স। আক্রমণই সেরা রক্ষণ।’’ ওই মন্ত্রীর মতে, ‘পাল্টা ভাষ্য’ তৈরি না করা গেলে দলের কর্মী-সমর্থকদের মনোবলে চিড় ধরবে। বিশেষত, সামনে যখন ছ’টি আসনে উপনির্বাচন রয়েছে। তার মধ্যে অন্তত দু’টি আসন (নৈহাটি এবং মেদিনীপুর) শহরাঞ্চলে। মনে রাখতে হবে, শহরাঞ্চলে লোকসভা ভোটে তৃণমূলের ফল ভাল হয়নি এবং আরজি কর আন্দোলনের প্রভাব পৌঁছেছিল। দলের এক সাংসদের কথায়, ‘‘সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে সিপিএমের ভূমিকা থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি। তখন সিপিএম গুটিয়ে গিয়েছিল। আমরা এর পরেও গুটিয়ে থাকলে সংগঠনকে রাস্তায় নামানো যাবে না।’’
তবে তৃণমূলের অনেকে এ-ও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, গোড়ার দিকে অনেকে মুখ খুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চ্যানেলে গিয়ে সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার-সহ অনেকের বক্তব্য দলের জন্য ‘অস্বস্তি’ তৈরি করে। পাশাপাশি, আরজি কর আন্দোলনের সময় জহর সরকার এবং সুখেন্দুশেখর রায়ের ভূমিকাও দলের ‘ভাবমূর্তি’ নিয়ে আলাদা প্রশ্ন তুলে দেয়। জহর রাজ্যসভার সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেন। সুখেন্দু ইস্তফা দেননি। কিন্তু একের পর এক পোস্ট করে ‘অস্বস্তি’ বাড়িয়েছেন। সেই পর্বও সামাল দিতে হয়েছে। যদিও তৃণমূলের একটা অংশ মনে করে, জহরের ইস্তফার কোনও ‘সুদূরপ্রসারী’ প্রভাব পড়েনি।