অনশন তুলে নিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। তবে আন্দোলন থেকে তাঁরা সরে আসেননি। এখনও তাঁরা বলছেন রাজপথ ছাড়ি নাই। সেই সঙ্গেই একাধিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন তাঁরা।
শুক্রবার সাংবাদিক বৈঠকে জুনিয়র ডাক্তারদের পক্ষে দেবাশিস হালদার তদন্ত ও চার্জশিট নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলে দিলেন।
তিনি জানিয়েছেন, অভয়ার বিচার না পাওয়ার ৮৪ তম দিন। বিচারের দাবিতে এতদিন ধরে সোচ্চার আমরা, সব বয়সের, সব শ্রেণীর মানুষ গর্জে উঠেছি বারবার, দখল নিয়েছি রাজপথ, স্লোগান তুলেছি কোটি কণ্ঠে। এই রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে গোটা দেশ, গোটা বিশ্ব অপেক্ষায় আছে অভয়ার ন্যায়বিচারের জন্য। আমরা দেখেছি কলকাতা পুলিশ কীভাবে তদন্তের নামে অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করেছে; দেখেছি প্রশাসন কীভাবে অপরাধীদের আড়াল করেছে। আন্দোলনের চাপে তদন্তভার গিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এর কাছে, নজরদারি করছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু এত কিছুর পরেও তদন্তের গতি এখনও অতি শ্লথ, বিচার এখনও অধরা। সিবিআই একটা প্রাথমিক চার্জশিট পেশ করেছে নিম্ন আদালতে। সমাজমাধ্যমে একটা নথি ঘুরছে যেটা সিবিআই চার্জশিট বলে মনে করা হচ্ছে। যদি তাই হয় তাহলে বলা যায় অত্যন্ত দুর্বল সেই চার্জশিটে ধোঁয়াশা অনেক, এই অপরাধ ঘিরে অনেক প্রশ্নেরই কোনও উত্তর নেই তাতে।
তাঁর প্রশ্ন, ৯ তারিখে অটোপসি থেকে স্যাম্পেল নেওয়া হলেও কেন্দ্রীয় ফরেনসিক ল্যাব এ পাঠানো হল ১৪ তারিখ। এত দেরি কেন?
সঞ্জয় রায় কে আটক করা হয় ৯ তারিখ রাতে, কিন্তু তার রক্তমাখা জামাকাপড় ব্যারাক থেকে নিয়ে আসা হয় ১২ তারিখ। আবার এত দেরি কেন?
চার্জশিটে খুব নির্দিষ্ট ভাবে ঘটনার দিনের টাইমলাইন দেওয়া আছে। যেমন ওইদিন দুপুর ১২:১৫ নাগাদ বাবা-মা আর জি কর হাসপাতালে এসে পৌঁছান তা বলা আছে। কিন্তু তাঁরা আসার পর কী হয়েছিল, কেন তাঁরা ৩ ঘণ্টা ধরে অভয়ার মৃতদেহের কাছে যেতে পারেন নি তার কোন উল্লেখ নেই।
একইভাবে ঠিক কোন সময় টালা থানায় এই ঘটনা জানানো হয়েছিল তারও কোনও উল্লেখ নেই।
কী কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ এফআইআর করেনি? কেন অভয়ার মা- বাবাকেই এফআইাআর করতে হয়?
৯ তারিখে সিজার মেমো তৈরি শেষ হয় রাত ১০:৪৫ এ, এফআইআর হয় ১১:৪৫ এ। তার আগেই ১১:৩০ এ আটক করা হয় সঞ্জয় কে। FIR এর আগেই এত দ্রুততার সাথে অপরাধী আটক হওয়াটা স্বাভাবিক ভাবেই সন্দেহের জন্ম দেয়।
অভয়ার বাবা - মা কে মৃতদেহের কাছে প্রায় ঘেঁষতেই দেওয়া হয়নি। মৃতদেহ সৎকারের কাজটুকুও তাদের করতে দেওয়া হয়নি। সৎকার কাজে পুলিশের এত দ্রুততার কারণ কী?কে নির্দেশ দিয়েছিল? কার নির্দেশে মৃতদেহ সৎকারের সময় বাড়ির লোকেদের সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি?
চার্জশিট অনুযায়ী সঞ্জয় রায় ভোর ৩:২০ তে আর জি কর হাসপাতালে ঢোকে, তারপর ট্রমা কেয়ার বিল্ডিংএ যায় ৩:৩৪ এ, বেরিয়ে আসে ৩:৩৬ এ। এরপর ইমার্জেন্সী বিল্ডিং এর ফোর্থ ফ্লোরে যায়। ৪:০৩ এ তাকে থার্ড ফ্লোরে চেস্ট মেডিসিন ওয়ার্ডের সিসিটিভি তে দেখা যায়। এর মাঝে প্রায় আধ ঘণ্টা সময় সে কি ফোর্থ ফ্লোরে ছিল? ফোর্থ ফ্লোরে সে কী করছিল?
সঞ্জয় রায় এর শরীরে আঘাতের চিহ্ন গুলি নির্যাতিতার প্রতিরোধের কারণেই হয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। নির্যাতিতার নখের যে নমুনা নেওয়া হয়েছিল পরীক্ষার জন্য তাতে কি সঞ্জয় রায় এর টিস্যু পাওয়া গেছে? উল্লেখ নেই চার্জশিটে। কেন?
সঞ্জয় রায় এর ব্লুটুথ ইয়ারফোনের উপর ভিত্তি করে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। চার্জশিটে চেস্ট মেডিসিন সিসিটিভিতে সঞ্জয় রাই এর গতিবিধির বর্ণনা দেওয়া আছে। ৪:০৩ এ ব্লুটুথ ইয়ারফোন গলায় সঞ্জয় ক্যামেরার ডানদিক থেকে ওয়ার্ডের দিকে যায়। ৪:৩২ এ সে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যায়, তখন তার গলায় ইয়ারফোন ছিল না। এর মধ্যে একবার ৪:৩১ এ ওয়ার্ড থেকে তাকে ক্যামেরার দিকে যেতে দেখা যায়, এবং আবার ওয়ার্ডে ফিরে যায়। লক্ষণীয় ভাবে এই সময় তার গলায় ইয়ারফোন টি ছিল কি না তা চার্জশিটে উল্লেখ নেই। কেন?
অভয়ার পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে যোনীপথে সাদা, চটচটে তরলের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। সেই তরলের পরীক্ষা করা হয়েছে কি? তার ডি এন এ অ্যানালাইসিস হয়েছে কি?
অভয়ার ধর্ষণ-খুন, প্রমাণ লোপাট ও তার সাথে আর জি কর মেডিকাল কলেজের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির মামলাদুটি শিয়ালদা কোর্টে বিচারাধীন আমরা জানি। অথচ এই মামলা চলার পর্যায়ে সিবিআই একাধিকবার অভিযুক্তদের আদালতে হাজির করায়নি, একাধিকবার সিবিআই এর আইনজীবী সময়ে আদালতে উপস্থিত হননি; এমনকি এও জানা যাচ্ছে যে দুর্নীতির মামলাটিতে সন্দীপ ঘোষ এবং অন্য অভিযুক্তদের জেরা করার প্রক্রিয়াও এগোয়নি। গত ২১ শে অক্টোবরের শুনানিতেও সিবিআই অভিযুক্তদের আদালতে পেশ করেনি৷
আমাদের নজর থাকবে চার তারিখ শিয়ালদা কোর্ট ও পাঁচ তারিখ সুপ্রিমকোর্টের শুনানির দিকে।
আগামী ৯ই নভেম্বর আরজি করের নারকীয় ঘটনার তিনমাস পেরিয়ে যাবে। তিনমাস মানে নব্বই দিন, ঠিক নব্বই দিনই CBI এর হাতে থাকে তদন্তের চার্জশিট পেশ করার জন্য। বিচার না পাওয়ার, বিচারের নামে প্রহসনের নব্বই দিন। ৯ই নভেম্বর আমরা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজগুলিতে অভয়ার স্মৃতিতে ‘দ্রোহের গ্যালারি’ প্রদর্শনী করতে চলেছি যেখানে এই চলমান আন্দোলনের বিভিন্ন মুহুর্ত কে ও মূলসুর কে ধরে রাখার চেষ্টা করা হবে বিভিন্ন ছবি, পোস্টার, কবিতা, আর্ট ইনস্টলেশন এর মাধ্যমে। ওই দিন আরজি কর হাসপাতালে রক্তদান শিবির এর আয়োজন হবে। এবং সেদিনই CBI তদন্ত ও চলমান আন্দোলন সম্বন্ধে জনতার মতামত নিতে, বিকেল তিন টেয় কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা অবধি ন্যায়বিচারের দাবিতে নাগরিক মিছিলের ডাক দিচ্ছি। বাংলার বিভিন্ন জেলায় জেলায় ন্যায়বিচারের দাবি নিয়ে আপামর জনগণকে আমরা পথে নামার আর্জি জানাচ্ছি ওইদিন। নিজেদের মতো করে প্রতিবাদ জানান বিচার এর দাবি তে, মিছিল হোক বা সমাবেশ, জমায়েত হোক বা মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা বা সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ সভা। প্রত্যেকে নিজেদের মত করে প্রতিবাদে সোচ্চার হোন, পাড়ায় পাড়ায়, এলাকায় এলাকায়, নিজেদের ক্লাব, সোসাইটি তে।
অভয়ার ন্যায়বিচার আমাদের অঙ্গীকার, আর একটিও অভয়া যাতে না ঘটে, তা সুনিশ্চিত করা আমাদের অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারকে কেউ রাজনৈতিক দলের ফাঁপা প্রতিশ্রুতি ভেবে ভুল করবেন না। তিলোত্তমার বিচার না নিয়ে আমরা আন্দোলন ছাড়ছি না, রাজপথ ছাড়ছি না। জানিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তাররা।