সাম্প্রতিক কালে ট্রোলের শিকার অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তীও। আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে জুনিয়র চিকিৎসকদের পাশে ছিলেন তিনি। ফেসবুকে সুদীপ্তার আর জি কর সংক্রান্ত পোস্টে এক ব্যক্তি লেখেন, ‘সুদীপ্তা কি ভোটে নামবে মাকুদের (সিপিএম) জন্য?’ ডাকাবুকো অভিনেত্রীর উত্তরের একটি অংশ ছিল, ‘হ্যাঁ, ভোটে দাঁড়াচ্ছি। সিট নিয়ে দরাদরি চলছে। ফাইনাল হলেই ঘোষণা করছি। সঙ্গে থাকবেন।’
উত্তরপ্রদেশের দশম শ্রেণির বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম হওয়া, বছর পনেরোর প্রাচী নিগমও ছাড় পায়নি ট্রোলিং থেকে। ৯৮.৫ শতাংশ নম্বর পাওয়া প্রাচীর সাফল্য ছাপিয়ে নেটিজেনদের একাংশের কাছে বড় হয়ে উঠেছিল তার মুখ। নেটিজেনদের কদর্য মন্তব্য নিয়ে ভাবতে চায় না প্রাচী। লক্ষ্যে পৌঁছনোই একমাত্র লক্ষ্য তার, বিবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সে কথাই জানিয়েছিল কিশোরী।
বিশ্ব জুড়ে সমাজমাধ্যমের মাথাব্যথা ট্রোলিং। শব্দটির উৎসস্থল স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল। সেখানকার দেশগুলিতে এর পরিচয়— মজার বদমায়েশ পুতুল। লম্বা নাক ও কানের জনপ্রিয় সেই পুতুল বিক্রি হয় ওই সব দেশে। তবে, তারা কোনও ক্ষতিকারক আচরণের প্রতীক নয়। কিন্তু এখন সেই অর্থ ছাপিয়েই ট্রোলিংয়ের অন্ধকার ছেয়ে রাখছে চারপাশের সমাজ তথা আন্তর্জালের দুনিয়াকে।
ট্রোলিংয়ের সমস্যায় জেরবার পাশ্চাত্যের দেশগুলিও। চলছে গবেষণা। তাতে উঠে এসেছে, ট্রোলিং তাঁরাই করেন, যাঁদের আত্মসম্মান বোধের অভাব এবং দৃষ্টি আকর্ষণের প্রবণতা রয়েছে। আত্মসম্মান যাঁদের বেশি, তাঁরা সমাজমাধ্যমকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন। গবেষণা বলছে, চারপাশকে নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা, আত্মমগ্নতা অর্থাৎ নিজের মধ্যে মগ্ন থাকা বা বিকৃত মানসিকতার শিকার ও সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিরাই ট্রোলিংয়ে জড়িত। ট্রোলিংয়ের শিকার হয়েছেন এমন অনেকের দাবি, বিকৃত মনের মানুষ সমাজমাধ্যমে ‘ইমোশনাল সিকিয়োরিটি’ পান। ইচ্ছে থাকলেও তাঁরা প্রকাশ্যে যেটা বলতে বা করতে পারেন না, সেটা তাঁরা সমাজমাধ্যমে আড়াল থেকে মন খুলে বলেন বা করেন। অর্থাৎ, মনোভাব বিকৃত। তাই সামনে প্রকাশ করতে দ্বিধা।
তবে মনোরোগ চিকিৎসক গৌতম সাহার মতে, ‘‘ট্রোলিং যাঁরা করেন, তাঁদের একাংশ পার্সোনালিটি ডিজ়অর্ডারের শিকার, এটা ঠিক। ট্রোলিংয়ে অভিযুক্তের নার্সিসিজ়ম, স্যাডিজ়ম এবং দৃষ্টি আকর্ষণের প্রবণতা সেই ডিজ়অর্ডারকেই মান্যতা দেয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই ধরনের অন্যায়কে মানসিক সমস্যা বললে শাস্তি মকুব হবে। যেটা উচিত নয়। যাঁদের কারণে ট্রোলিংয়ের মতো সামাজিক ব্যাধি অসহিষ্ণুতা ছড়াচ্ছে, তাঁরা শাস্তিরই যোগ্য।’’ গৌতম জানান, ছোটদের ক্ষেত্রে শৈশব থেকেই এ সব নিয়ে সচেতন করবেন অভিভাবক, শিক্ষকেরা। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার ভুল বার্তা যাচ্ছে। সচেতনতায় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাও যথেষ্ট।
নাট্যকর্মী সোহিনী সেনগুপ্তের মত, ‘‘এখন আমরা নিজের কাজ নিয়ে কম ভাবি। ভাবনা জুড়ে থাকে অন্য কেউ। কী খাব, কী বই পড়ব, কী সিনেমা দেখব— সবটাই সমাজমাধ্যমের লাইক, কমেন্টের ভিত্তিতে অন্যের বৈধতার অপেক্ষায় থাকে। মানুষ বিভ্রমে বাঁচে। তা ভাঙতে নিজেকে প্রশ্ন করতে হয়, চর্চা করতে হয়। পরিবর্তে সমাজমাধ্যমে ঢুকে বিনা পরিশ্রমে নিজেকে জাহির করে বা ট্রোল করে তৃপ্তি মিলছে।’’ সোহিনীর কথায়, সমাজমাধ্যম-নির্ভর জীবন থেকে কিছুই অর্জন হয় না। অর্জনের খিদে না এলে ট্রোলিংয়ের প্রবণতা ঠেকানো অসম্ভব। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, রোজ কয়েক ঘণ্টা মোবাইল থেকে দূরে থেকে নিয়মানুবর্তিতায় বাঁধতে হবে।
মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেল আবার বলছেন, ‘‘ট্রোলিংয়ে অভিযুক্তদের উদ্দেশ্য বা চরিত্রকে এক ছকে ফেলা যাবে না। আর্থ-সামাজিক, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বা সাম্প্রদায়িক গোলমালের প্রেক্ষিতে ট্রোলিং যাঁরা করেন, তাঁদের মানসিক অসুস্থতা থাকে না। বরং যখন কেউ সমাজমাধ্যমে অহেতুক হেনস্থা করেন, অশালীন কথা বলেন, বুঝতে হবে তাঁর ব্যক্তিত্বে অস্থিরতা আছে কিংবা তিনি মানসিক বিকারগ্রস্ত। মন্তব্যকারী আড়ালে থাকায় এই প্রবণতায় রাশ টানাও কঠিন। এঁদের অনেকেই হয়তো মুখোমুখি হলে এমন মন্তব্য করতেন না।’’ সুজিতের পরামর্শ, ট্রোলিং রুখতে প্রয়োজন উপযুক্ত সাইবার আইন। তা হলেই শাস্তির ভয়ে, লোকলজ্জা বা সমাজের ভয়ে সতর্ক হবেন ট্রোলার।
সব পক্ষেরই পরামর্শ, ট্রোল করা হলে বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে যান। যিনি মন্তব্য করছেন, তিনি যখন বুঝবেন যে কোনও ভাবেই ‘ভাইরাল’ হচ্ছেন না, তখনই তাঁর ট্রোল করার খিদে কমে যাবে।
(চলবে)