• সুবর্ণরৈখিক প্রাচীন উৎসব 'পৈড়ান'! লোকসংস্কৃতির আবহমান কাব্য...
    ২৪ ঘন্টা | ০৩ নভেম্বর ২০২৪
  • সৌরভ চৌধুরী: গ্রামবাংলায় চাষকে কেন্দ্র করেই মানুষের জীবনজীবিকা। তাই চাষের ফলন বৃদ্ধির জন্য একাধিক লোকাচার পালিত হয়। 'পৈড়ান'ও এমনই এক উৎসব। কৃষি-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত সুবর্ণরৈখিক এক প্রাচীন উৎসব এটি। কালীপুজোর পরের দিন কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

    কৃষক পরিবারের উঠানে এক জায়গায় গর্ত করা হয়। সেখানে পাট অথবা বনের লতা দিয়ে বিনুনি করে তার একাংশ ঐ গর্তের মধ্যে পুঁতে দেওয়া হয়। পোঁতা অংশকে কাঠের বাটাম দিয়ে পেরেক দিয়ে শক্ত করে আটকে দেওয়া হয় যাতে কেউ সহজে টেনে তুলতে না পারে। তার পর মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে গোবরজল দিয়ে শুদ্ধ করা হয়। একেই পৈড়ান গাড়া বলে। তা সাজানো হয় নানা ফুল দিয়ে। এতে মাখানো হয় পিঠালি বাটা বা পিটুলি। এর পর আতপচাল, হরিতকী, দূর্বাঘাস, সিঁদুর, ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। গ্রামের যুবকরা এবং ক্ষেত মজুররা শালবল্লা বা শক্ত বাঁশের সাহায্যে সেই পাটের বিনুনিকে মাটির তলা থেকে টেনে তোলেন। আর বাজতে থাকে মাদল, ঢোলের মতো নানা রকম বাদ্যযন্ত্র। যে বা যাঁরা পৈড়ান তোলেন তাঁদের জন্য থাকে পুরস্কার। যার বেশিরভাগটা খাদ্যদ্রব্য। শোনা যায়, কোন কোন সম্পন্ন কৃষক পুরস্কার হিসেবে ছাগল বেঁধে রাখতেন। আবার বিনুনি ছিঁড়ে গেলে যিনি পুঁতেছেন তাঁকে "ফাইন" দিতে হত। জরুমানা স্বরূপ পৈড়ান তোলার দলকে খাওয়াতে হত।

    এই লৌকিক উৎসব তথা লৌকিক ক্রীড়ায় দীর্ঘ দিন চাষ বন্ধ থাকার পর নতুন করে চাষাবাদ শুরুর আগে এটাও একরকম খেলার ছলে শারীরিক কসরত বলাই যায়। কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষেদের শক্তি পরীক্ষার কাজও চলে এর মধ্যে দিয়ে। সময়ের সঙ্গে উৎসবের ধরন বদলেছে। আগে প্রায় সমস্ত কৃষক পরিবারে এই উৎসব হলেও বর্তমানে গ্রামের কোথাও কোথাও নিজ উদ্যোগে গ্রামবাসীরা পৈড়ান গাড়েন এবং তোলেন। এখনও জঙ্গলমহলের সুবর্ণরেখা অববাহিকার ঝাড়গ্রামের জুনশোলা গ্রাম-সহ বেশ কিছু গ্রামে পৈড়ান হয়। এবারেও বিশ্বজিৎ পাল, সুব্রত পাল, সোমনাথ সেনাপতি, রিপন মান্না, সুমন পাল, সঞ্জয় দন্ডপাট, অমল পালের মতো কিছু উৎসাহী যুবকের উদ্যোগে জুনশোলা গ্রামে পৈড়ান অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

    কারও কারও মতে, পৈড়ান আসলে দৈত্যরাজ বলি পূজার অঙ্গ। পুরাণমতে, বিষ্ণুভক্ত দৈত্য প্রহ্লাদের পৌত্র ছিলেন বলিরাজ। তিনি বিষ্ণুবিদ্বেষী ছিলেন। তাঁকে সৎ পথে ফেরাতে বিষ্ণু তাঁকে পাতালপ্রবেশে বাধ্য করেন। তাঁর ভুল বোঝার পর তাঁকে ফের পাতাল থেকে উদ্ধার করা হয়।

    কথিত আছে, কার্তিক মাসের অমাবস্যার প্রতিপদে দৈত্যরাজ বলিকে স্মরণ করলে পুণ্য হয়। তাই অনেকে মনে করেন, পৈড়ান তোলার মধ্য দিয়ে দৈত্যরাজ বলির চুলের মুঠি তুলে পাতাল থেকে তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়।

    এ বিষয়ে গ্রামের বাসিন্দারা বলেন, আধুনিকতার ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে এই কৃষি-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত উৎসবগুলি হারিয়ে যেতে বসেছে। এগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। কালের প্রবাহে অনেক লোক-উৎসব জঙ্গলমহল থেকে হারিয়ে গিয়েছে। পৈড়ান এখনও ধারাবাহিক। হারিয়ে যেতে-বসা এই উৎসবকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতি বছর এই সময়ে এই অনুষ্ঠান ধুমধাম করে পালিত হয় ঝাড়গ্রামের জুনশোলা গ্রাম-সহ জঙ্গলমহলের একাধিক এলাকায়।

  • Link to this news (২৪ ঘন্টা)