নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: একটা হাঁস। তার কমলা ঠোঁট। ছোট্ট দু’টি চোখ, কালো। দু’আঙুলে ধরে হাঁসকে থালায় ছোটাতে হবে। তারপর কপাত করে খেয়ে নিতে হবে মাথাটা। তার পাশে সফেদ হাতি। তার শুঁড়টা আগে খেতে হয়। আর আছে মাছ। কুকুরও আছে। ফোঁটা নিয়ে ভাই সেগুলি খাচ্ছে এখন। বোন দেখছে। তার আজ হাত দেওয়া বারণ। ভাগ পাবে না বলে ঠোঁট একটু ফুলেছে। তবে জানা গেল, তার জন্যই এসেছে। ফোঁটাপর্ব শেষ হলে পাবে। যতই ফিউশন, সুদৃশ্য মিষ্টি কেনার ঝোঁক বাড়ুক ভাইফোঁটায়, আদি, অকৃত্রিম এই খেলনা মিষ্টির কদর এখনও সর্বজনীন। দিদির কাছে ভাই তো চিরকালই ছোট। বোন তো চিরকালই দাদার কাছে পুঁচকে। তাই খেলনা মিষ্টি ছাড়া বাঙালির কোনও বয়সেই প্লেট ভরে না। পেটও ভরে না। তাই আজও ভাইফোঁটার সময় কলকাতার অলিগলিতে হাঁস-হাতি-কুকুর-মাছের দেখা মেলে। আজও আম-ফুটি-আপেল-বেদানা মিষ্টি জ্বলজ্বল করে শো কেসে। এই পিৎজা-বার্গার-ফ্রায়েড চিকেনের দুনিয়াতেও দিব্যি বোঝা যায়, কলকাতা আর কলকাতার বাঙালি কলকাতাতেই আছে।
‘কোনটা নিবি দাদা’ খুদে বোনের প্রশ্ন তার খুদে দাদাকে। ‘ওইটা নেব। একটা হাঁস, একটা মাছ’—বলল দাদা। মা পাশে দাঁড়িয়ে। কেনা হল একজোড়া করে। বউবাজারে মিষ্টির দোকানে দাঁড়িয়ে তখন মা-ও নস্টালজিক। একদিনের জন্য হলেও ফিরে পেলেন ছোটবেলায় ভাইকে দেওয়া সেই, সেই খেলনা মিষ্টি। আজ যা নিয়ে খেলছে তাঁর সন্তানরা। বললেন, ‘বাঙালির কাছে তো মিষ্টি স্রেফ খাদ্য নয়। শতকের পর শতকজুড়ে বিচরণ করতে করতে সে নিরন্তর ভালোলাগা লিখে চলেছে। যার মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে প্রজন্মের পর প্রজন্মের স্মৃতিকথা।’
এটাও ঠিক, ইদানিং কলকাতার ঝাঁ চকচকে মিষ্টির দোকানগুলিতে খুব একটা দেখা মেলে না এই খেলনা মিষ্টির। খিদিরপুরের সতীশ ময়রা অবশ্য ব্যতিক্রম। খেলনা মিষ্টি ভর্তি সে দোকানে। আর মেলে বউবাজারে। উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার বহু গলির পুরনো ছোট দোকানগুলিতে। সতীশের কর্ণধার অরূপকুমার দাস বলেন, ‘আমাদের প্রসিদ্ধি প্রাচীন মিষ্টিগুলিকে ধরে রাখি বলে।’ ‘ভাইফোঁটার সময় একখানা সুন্দর দেখতে হাঁস পাতে না থাকলে কারও ভালোই লাগে না’— বক্তব্য শ্যামবাজারের মাঝবয়সী এক দিদি মাধবী মুখোপাধ্যায়ের। ফোঁটার থালায় দেবেন বলে মাঝবয়সি ভাইয়ের জন্য কিনলেন। বেহালার কমলেশ্বর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘ভাইফোঁটায় বাবা নিয়ে আসত ছোটদের জন্য। কে প্রথম মাথা খাবে, কে পাখনা খাবে তা নিয়ে ঝগড়া করতাম।’ হাঁস-হাতি-মাছ দেখে স্বপ্নে বিভোর চতুর্থ শ্রেণির শ্রেয়ান বসু। সে মোটেও খাবে না। ‘একটা হাঁস আর একটা মাছ কিনেছি। খাব না। রেখে দেব’—সাফ জানিয়ে দিল।