আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের অভিবাসীদের নিজ দেশে ‘গণ চালান’ (মাস ডিপোর্টেশন)-এর হুমকির আবহে ১০০ বছর আগের এশিয়ায় আমেরিকান আইন নিয়ে অসন্তোষের কথাই মেলে ধরেন সুগত। ১৯২৪ সালের ২৮ মে আমেরিকায় এশীয় অভিবাসী বিরোধী আইন জারির সময়ে চিনে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরের দিনই চিন থেকে জাপানে রওনা দেবেন কবি। সুগত তাঁর বক্তৃতায় বলছিলেন, সেই সময়ে চিনে ও জাপানে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমি জাতি-রাষ্ট্রের ভাবনার বিপ্রতীপে নৈতিক মূল্যবোধ বা সত্যিকারের সহমর্মিতার ভিত্তিতে এক ধরনের এশীয় ঐক্যর ভাবনার কথা বলেছিলেন। অনেকের চোখেই যা, আজও প্রাসঙ্গিক। সুগতের ‘এশিয়া আফটার ইউরোপ’ বইটিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দেশান্তরী ভারতীয়দের একটি সমিতি ‘ইন্ডিয়ান ডায়াস্পোরা ওয়াশিংটন ডিসি মেট্রো’-র ডাকে অনুষ্ঠানে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও রাজনীতি, ১৯২৪-১৯৪১’-শীর্ষক বক্তৃতায় এই কথা বলেন সুগত।
হার্ভার্ডের ইতিহাসবিদ অধ্যাপকের কথায়, ‘‘চিনে রবীন্দ্রনাথ নৈতিকতাবোধ ও প্রকৃত সহানুভূতির মাধ্যমে এশীয় ঐক্যর কথা বলেন। জাপানে গিয়ে বলেন, শান্তি স্থাপনের জন্য রাষ্ট্রের দানোকে আমাদের তাড়াতেই হবে। আমেরিকায় এশীয়দের অভিবাসন বিরোধী আইনের প্রতিবাদে চিনা প্রেসিডেন্ট সুন ইয়াত-সেনও এর পরেই জাপানে গিয়ে একই কথা বলেছিলেন।’’
সুগতের বক্তৃতা প্রসঙ্গে পরে দীর্ঘ মন্তব্য করেন অমর্ত্য সেন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের কথাতেও দুই বিশ্বযুদ্ধ থেকে সমকালের নানা ঘটনা বা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন উপলব্ধির কথা উঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সভ্যতার সঙ্কট বা রাশিয়ার চিঠি-র কথা বলেন অমর্ত্য। রাশিয়ার চিঠি নিয়ে ব্রিটিশদের অস্বস্তি মনে করিয়ে অমর্ত্য বলেন, ‘‘দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ভারতে তা প্রকাশের অনুমতি দেয়নি ব্রিটিশ সরকার।’’ গীতাঞ্জলির জন্য নোবেল পুরস্কার জয়ী বাঙালি কবিকে তাঁর সমকালে বা এখনও অনেকেই শুধু সাদা দাড়ির গুরুগম্ভীর ঋষিপ্রতিম ব্যক্তি হিসাবে দেখেন। এ দিন সুগত এবং অমর্ত্যের কথা অনেকটাই সেই ভুল ভাঙায় সরব হয়।
আজকের ভারতে বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদকে কী চোখে দেখতেন রবীন্দ্রনাথ? প্রশ্নোত্তর পর্বে এর জবাব দিয়ে অমর্ত্য বলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে পড়লেই বোঝা যায় সংখ্যাগুরুর স্বৈরাচার রবীন্দ্রনাথের অপছন্দ ছিল। বিজেপির এক রকম পূর্বসূরি হিন্দু মহাসভার সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর মতো ধর্মনিরপেক্ষ নেতাদের তর্কেও কবি সুভাষদেরই সমর্থন করেন।’’ সুগতও এ দিন বলেছেন, ‘‘চিনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ধর্ম বলতে কবির ধর্মকে মেলে ধরেছিলেন। ১৯৩০এর দশকে পরিশেষ কাব্যে প্রশ্ন কবিতাটির অসন্তোষ বুঝিয়ে দেয় গীতাঞ্জলির অধ্যাত্মবাদ থেকে কত দূরে সরে এসেছেন কবি।’’ সুগত মনে করান, গান্ধীর সঙ্গে নানা তর্কে বার বার বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, আধুনিকতা, উন্নয়নের পক্ষ নেন রবীন্দ্রনাথ। সুভাষ, নেহরু, মেঘনাদ সাহাদের ভারত গড়ার আর্থ-সামাজিক ভাবনায় গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন। সুগতের মতে, সুভাষচন্দ্রকে ‘দেশনায়ক’ বলে বরণেও উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে প্রবীণ রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট অবস্থান বোঝা যায়। দেশের দুঃখ নিজের বলে বরণ করে সুভাষের আত্মদান দেশের স্বাধীনতা অনিবার্য করে তুলেছে বলে জীবন সায়াহ্নে নিশ্চিত হন রবীন্দ্রনাথ।