বনেদি বাড়ি ছেড়ে জগদ্ধাত্রী সর্বজনীন শতাব্দী প্রাচীন পুজো ঘিরে উন্মাদনা
বর্তমান | ০৭ নভেম্বর ২০২৪
নিজস্ব প্রতিনিধি, চুঁচুড়া: ১৯৬২ সালে চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো হতো ২৬টি। বর্তমানে পুজোর সংখ্যা ১৭৭। সঙ্গে লাফিয়ে বেড়েছে জনপ্রিয়তা। কিছু বনেদি বাড়ির পুজো সর্বজনীন রূপ পেয়েছে। জুড়েছে অতিরিক্ত জৌলুস। থিম প্রবেশ করেছে। বিশ্বখ্যাত আলোর বহরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু অনেক খুঁজেও জানা যায় না, পুজো সংক্রান্ত ঠিকুজিকষ্ঠি। ফলে এখনও তর্ক চলে জগদ্ধাত্রী পুজো আগে কোথায় হয়েছে? চন্দননগর না কৃষ্ণনগরে। চন্দননগরের প্রথম বা দ্বিতীয় পুজোর ইতিহাস অবশ্য মেলে। মেলে পুজোর সঙ্গে জুড়ে থাকা জনশ্রুতি আর বেনজির নিয়মরীতির খতিয়ানও। থিমের বাড়বাড়ন্তের যুগেও সে সব ঢাকা পড়েনি। তর্কযোগ্যভাবে হলেও তিন শতাব্দী পার করেও আলোর শহরে সে কাহিনি উজ্জ্বল হয়ে বিরাজ করে, বিশেষ করে পুজো মরশুমে।
ইতিহাস বলে, সাবেক ফরাসি তালুক চন্দননগরে ফরাসিদের দেওয়ান ছিলেন ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। ধনবান ইন্দ্রনারায়ণের কাছে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পর্যন্ত টাকা ধার নিতেন। দু’জনের ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। সেই ইন্দ্রনারায়ণের উদ্যোগে চাউলপট্টি বা নীচেপট্টিতে প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোটি হয়। অনেকের দাবি, পুজো হতো চৌধুরী বাড়িতে। পরে তা সর্বজনীন করতে চাউলপট্টিতে আনা হয়। জনশ্রুতি যাই হোক, সেই পুজোই আজও চন্দননগরের আদিপুজো। তাই চাউলপট্টি জগদ্ধাত্রী চন্দননগরের ‘আদি-মা’ হিসেবে পরিচিত। এখনও ‘আদি-মা’র ভাসান না হলে অন্য পুজোর ভাসান হয় না। জনশ্রুতি, এই পুজোর সংকল্প আজও চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামেই হয়। চাউলপট্টির ব্যবসায়ীদের মতোই সে যুগে রমরমা ছিল কাপড়পট্টির বস্ত্র ব্যবসায়ীদেরও। সে যুগে চন্দননগর থেকে মসলিন কাপড় যেত ফ্যাশন জগতের আঁতুড়ঘর ফরাসি দেশে। জনশ্রুতি, চাউলপট্টির ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুজো নিয়ে বিবাদেই দ্বিতীয় পুজোর আয়োজন হয় কাপড়পট্টি বা উঁচুপট্টিতে। সেই পুজোর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় নামে সম্ভ্রান্ত এক বস্ত্র ব্যবসায়ী। তৃতীয় পুজোটি সাবেক উড়েপাড়ায় শুরু হয়েছিল। সালটি ছিল বাংলা ১২৪২। বর্তমানে সেই জায়গার নাম বাগবাজার।
পুজোর নানা রীতি রেওয়াজের ক্ষেত্রেও চন্দননগরে বেশ কিছু বেনজির ঘটনা দেখা যায়। পুজো শুরুর দিন থেকে তেঁতুলতলা সর্বজনীনের পুজোয় দেবীবরণ করেন পুরুষরা। মজা হচ্ছে, পুরুষরা নারীবেশে দেবীকে বরণ করেন। শাড়ি এবং শাঁখা-সিঁদুরে সাজেন তাঁরা। এর কার্যকারণ নিয়ে নানা জনশ্রুতি। তবে আজও দশমীতে ওই রীতিতেই বরণ হয়। জনশ্রুতি, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের কিছু বছর পর তেঁতুলতলার পুজো শুরু হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাতা দাতারাম সুর। তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বিশ্বস্ত এক কর্মচারী। একাধিক জায়গা বদলের পর পুজো বর্তমানে তেঁতুলতলাতে এসেছে। সে কালে মেয়েরা পুরুষদের সামনে আসতেন না। দাতারামের দুই বিধবা মেয়ে ছিলেন পুজোর মূল উদ্যোক্তা। তাই পুরুষদের মহিলা সাজিয়ে বরণ করার প্রথা চালু হয়। ওই প্রথায় যাত্রাপালার ছেলেদের সঙ সাজার একটি ভূমিকা আছে। সময় বদলে গেলেও সাবেক রীতিগুলি বদলায়নি। অনেকে মনে করেন, দাতারামের দুই মেয়ে পুজোর উদ্যোক্তা ছিলেন। তাই তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই পুরুষরা নারী বেশ নেন। এ নিয়ে অবশ্য সঠিক তথ্য আজও অমিল। সাবেক রীতির অনুসরণে বাতাস পায় জনশ্রুতি।