• অভিষেক-প্রস্তাবে তৃণমূলে বদলের হাওয়া ‘ঝড়’ হচ্ছে, তবে আপাতত অব্যাহতি ফিরহাদের, বাদ কলকাতা
    আনন্দবাজার | ০৭ নভেম্বর ২০২৪
  • দলের সেনাপতি হিসেবে তিনি নির্ভর করেন সংখ্যায় (ডেটা)। বিশ্বাস করেন একটি মন্ত্রে— ‘পারফরম্যান্স’। কর্মদক্ষতা। তিনি মনে করেন, দক্ষ না হলে পদ থেকে সরে যেতে হবে। দলের পদে থাকার এক এবং একমাত্র শর্ত হবে সংশ্লিষ্ট নেতা, কর্মীর দক্ষতা। তাঁর ‘আনুগত্য’ নয়।

    সেই নিরিখেই দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তৃণমূলের অন্দরে বড় ‘রদবদল’-এ প্রস্তাব পাঠিয়ে দিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে তৃণমূলের সেনাপতি জানিয়েছিলেন, ‘পারফরম্যান্স’ জরিপ করে পুরসভা স্তরে প্রশাসনে এবং সংগঠনে রদবদলের পথে হাঁটবে দল। যার পটভূমি ছিল, লোকসভা ভোটে শহরাঞ্চলে তৃণমূলের খারাপ ফল। সারা রাজ্যে মোট ৭০টিরও বেশি ‘কর্পোরেশন’ এবং পুরসভা (মিউনিসিপ্যালিটি) এলাকায় তৃণমূলের চেয়ে এগিয়ে ছিল বিজেপি। যার মধ্যে ছিল কলকাতাও। দলের অন্দরে সাংগঠনিক পরিবর্তনের হাওয়া তখন থেকেই বইতে শুরু করেছিল। বৃহস্পতিবার অভিষেক যা ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাতে স্পষ্ট যে, তৃণমূলে বদলের সেই হাওয়া ঝড়ে পরিণত হতে চলেছে। তবে উল্লেখযোগ্য ভাবে, আপাতত ঝড় থেকে রেহাই পাচ্ছেন কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। আপাতত।

    দলের অন্দরে অভিষেক-ফিরহাদ সম্পর্ক ‘মসৃণ’ নয়। প্রকাশ্যে কেউই অবশ্য তা নিয়ে মন্তব্য করেন না। কিন্তু গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ঘটনায় পরোক্ষে হলেও দু’জনের সম্পর্কের ‘সমীকরণ’ প্রকাশ্যে চলে এসেছে। যার বেশিরভাগ কলকাতা পুরসভা সংক্রান্ত। এর মধ্যে একটি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল স্বয়ং মমতাকে! দু’জনের ঘনিষ্ঠেরা দুই নেতা সম্পর্কে জনান্তিকে খুব ‘সদয়’ মন্তব্যও করেন না। লোকসভা ভোটে কলকাতার দু’টি কেন্দ্রে জিতলেও কলকাতা পুর এলাকায় মোট ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪৬টি ওয়ার্ডে বিজেপির চেয়ে পিছিয়ে ছিল শাসক তৃণমূল। যেখানে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার পুরভোটে ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩৭টি ওয়ার্ডেই জিতেছিল শাসকদল। তিন বছরের ব্যবধানে ফলাফল যে খারাপ হয়েছে, তা সংখ্যাতেই স্পষ্ট। ফলে অনেকে মনে করেছিলেন, কলকাতার মেয়র হিসেবে ফিরহাদের ‘ব্যর্থতা’ সামনে আসবে। অভিষেকের সঙ্গে তাঁর ‘মধুর’ সম্পর্কের কারণে সেই জল্পনা আরও জোরালো হয়েছিল। যদিও পাশাপাশিই দলের অন্য একটি অংশ বলছিলেন, ফিরহাদ একে সংখ্যালঘু নেতা। দ্বিতীয়ত, তিনি স্বয়ং মমতার ‘আস্থাভাজন’। ফলে তাঁকে বদল করা সহজ হবে না। ‘বিকল্প’ কাউকে পাওয়া যাবে কি না, সেই জল্পনাও ছিল।

    সেই জল্পনার অবসান ঘটিয়ে বৃহস্পতিবার অভিষেক বলে দিয়েছেন, ‘‘আপাতত কলকাতায় কোনও বদল হচ্ছে না।’’ তবে পাশাপাশিই তিনি বলে রেখেছেন, ‘‘পরে সেটাও হবে। কারণ, এর পরে পঞ্চায়েত স্তরেও আমাদের রদবদল করতে হবে।’’ অভিষেক আরও এক বার স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ‘পারফরম্যান্স’ই তাঁর কাছে শেষকথা। ‘আনুগত্য’ কোনও পদে থাকার সূচক নয়। তাঁর কথায়, ‘‘আনুগত্য দিয়ে আমি কী করব? ভাল ছেলে। কিন্তু কোনও কাজের নয়। আমার লাভ কী?’’

    তবে কলকাতায় এখন রদবদল না হলেও বেশ কয়েকটি ‘কর্পোরেশন’ এলাকায় রদবদলের প্রস্তাব তিনি দলনেত্রীকে জানিয়েছেন বলে স্পষ্ট করেছেন তৃণমূলের সেনাপতি। সেই সূত্রেই কৌতূহল তৈরি হয়েছে শিলিগুড়ি নিয়ে। কারণ, শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেবের কাজ নিয়ে তৃণমূলের শীর্ষমহল যে সন্তুষ্ট, তেমন নয়।

    অভিষেক জানিয়েছেন, রদবদল সংক্রান্ত তাঁর সমস্ত প্রস্তাব তিনি আমেরিকায় চোখের অস্ত্রোপচার করাতে যাওয়ার আগেই দলনেত্রী মমতাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে অভিষেক জানিয়েছিলেন, তিন মাসের মধ্যে রদবদল হবে। তার আগেই সেই সংক্রান্ত দলীয় সুপারিশ বা প্রস্তাব নেত্রীর কাছে জমা পড়বে। সেই সময় মেনেই প্রস্তাব জমা পড়েছিল মমতার কাছে। যদিও শারোদোৎসবের জন্য সেই রদবদল করা হয়ে ওঠেনি। উপরন্তু, ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন এসে পড়েছে। অভিষেক অবশ্য ইঙ্গিত দিয়েছেন, উপনির্বাচন মিটলেই রদবদল ঘোষণা হয়ে যেতে পারে।

    প্রথমে অভিষেক জানিয়েছিলেন, পুরসভা এলাকায় খারাপ ফলাফল বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট পুর চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এমনকি, টাউন সভাপতিও বদল করা হবে। তবে এখনই টাউন সভাপতি বদলের পথে হাঁটছে না তৃণমূল। অভিষেক জানিয়েছেন, আপাতত পুরসভার চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যানদের ‘ভূমিকা’ খতিয়ে দেখে তাঁদের বদল করা হবে। কোন পুরসভায় কার বদলে কাকে পদাধিকারী করা উচিত, সেই নামের প্রস্তাবও মমতাকে দিয়ে রেখেছেন অভিষেক।

    শুধু পুরসভার প্রশাসনিক স্তরের পাশাপাশিই একাধিক সাংগঠনিক জেলা সভাপতিও বদল করতে চলেছে তৃণমূল। অভিষেক জানিয়েছেন, অনেকগুলি জেলা সভাপতি পদেই বদল করা হবে। কত জন, সেই সংখ্যা নির্দিষ্ট করে তিনি বলেননি। তবে কমবেশি ১০ জন জেলা সভাপতি বদল করে সংগঠনে বড় ‘ঝাঁকুনি’ দিতে চলেছে শাসকদল। এই সমস্ত বদলেরই ‘মাপকাঠি’ লোকসভা ভোটের ফলাফল। অভিষেক স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এ নিয়ে সাংগঠনিক স্তরে কোনও সমীক্ষা করানো হয়নি। ‘সূচক’ লোকসভার ফল। তার ভিত্তিতেই রদবদল করা হবে। ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে সংগঠনে নাড়াচাড়া দিতেই যে বদল, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন তৃণমূলের সেনাপতি।

    অনুব্রত মণ্ডল গরুপাচার মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পরে বীরভূমের সংগঠন পরিচালনায় কোর কমিটি গড়ে দিয়েছিলেন দলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা। এ-ও বলেছিলেন, অনুব্রত ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনিই বীরভূমের সংগঠন দেখবেন। অনুব্রত জামিন পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও শুরু করেছেন। এই পরিস্থিতে কোর কমিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে তৃণমূলে নানা আলোচনা চলছিল। অভিষেক ওই বিষয়ে তাঁর ‘ব্যক্তিগত অভিমত’ ব্যক্ত করেছেন। তাঁর কথায়,‘‘আমার ব্যক্তিগত মত, কোর কমিটি থাকা উচিত। কারণ, এই কোর কমিটিই বীরভূমে আমাদের দু’টি (লোকসভা) আসনে জয় ধরে রেখেছে। ব্যবধানও বাড়িয়েছে।’’ তা হলে জেলা সভাপতি অনুব্রতের ভূমিকা কী হবে? অভিষেক স্মিত হেসে বলেন, ‘‘কেন? উনি কোর কমিটিকে পরিচালনা করবেন।’’ উল্লেখ্য, কোর কমিটি রাখার পক্ষেই মতামত জানিয়েছেন অনুব্রত। তিনি বলেছিলেন, ‘‘কোর কমিটির সদস্যের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা যায় কি না, সে বিষয়ে আমি দিদি এবং অভিষেকের সঙ্গে কথা বলব। কারণ, অনেকেই বোলপুরের। আরও অন্য জায়গা থেকে সদস্য নেওয়া দরকার।’’ অভিষেকও তাঁ ‘ব্যক্তিগত’ মতামত কোর কমিটি রাখার পক্ষেই দিয়েছেন।

    প্রসঙ্গত, বীরভূমের কোর কমিটির অন্যতম চালিকাশক্তি হলেন বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি কাজল শেখ। যাঁর সঙ্গে অনুব্রতের সম্পর্ক বরাবরই ‘মধুর’। ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবার কঙ্কালীতলায় পুজো দিয়ে, ১১টি কেক কেটে এবং দুঃস্থ মানুষদের সেই কেক খাইয়ে অভিষেকের জন্মদিন ‘পালন’ করেছেন কাজল। পক্ষান্তরে, অনুব্রত-সহ তাঁর কোনও অনুগামীর সমাজমাধ্যমে অভিষেকের কোনও ছবি দেখা যায়নি।

  • Link to this news (আনন্দবাজার)