• একদা শস্য, খাদ্যসামগ্রী মাপার সের-পাই ‘সিউড়ি বোলস’ এখন শুধুই শো-পিস
    বর্তমান | ০৮ নভেম্বর ২০২৪
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, সিউড়ি: মানব সভ্যতায় বস্তুর পরিমাপের প্রয়োজনে তৈরি হয় এককের ব্যবহার। আধুনিককালে তা কেজি, গ্রাম এইসব নামে পরিমাপ করা হয়। আগেকার দিনে একক হিসাবে ছিল সের, মন ইত্যাদি। একসময় ছিল গৃহস্থের অতিপ্রয়োজনীয় মাপকবস্তু। তা এখন হয়ে উঠেছে গৃহসজ্জার সামগ্রী। এটি ‘সিউড়ি বোলস’ নামে পরিচিত। এর একমাত্র কারিগর বীরভূমের লোকপুরের ভোলানাথ কর্মকার। তিনি সারা বছর মগ্ন এই ‘সের-পাই’ তৈরিতে। অন্যান্য রাজ্য ও বিশ্বে গৃহসজ্জার সরঞ্জাম হিসাবে সের-পাইয়ের কদর বাড়লেও ক’জনই বা জানেন এই কারিগরের কথা!

    আগে গৃহস্থের চাল মাপা থেকে শস্য, খাদ্যসামগ্রী মাপা হতো পাই দিয়ে। মাপন এই বস্তু বা যন্ত্রটি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত। কাঠ কিংবা বেতের একটি ছোট পাত্রের নির্দিষ্ট মাপ থাকে। সেই মাপকেই একক হিসাবে ধরে শস্য, চাল ওজন করা হতো। গ্রামবাংলায় প্রচলিত আছে, এক সের ধান, এক পাই চাল ইত্যাদি। কিন্তু কালের নিয়মে পরিমাপের যন্ত্র ও পদ্ধতিতে পুরোপুরি আধুনিকতা এসেছে। কাঠের পাই-এ ওজন মাপার জায়গায় এসেছে বৈদ্যুতিন সব নানান যন্ত্রপাতি। কিন্তু মানুষের মনের কোণের এক অংশে নস্টালজিক হয়ে এখনও রয়ে গেছে এই মাপকবস্তুটি। এখন তা শোপিসে পরিণত হয়েছে। এই সের-পাই তৈরির সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে নাম চলে আসে খয়রাশোল ব্লকের লোকপুরের নাম। জানা যায়, ইংরেজ আমলেও এই লোকপুর এলাকায় ৪টি পরিবার সের-পাই তৈরি করতেন। এলাকার কমলাকান্ত কর্মকার কাঠের সের ও পাইয়ের উপর পিতলের নকশা শুরু করেন, যা গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে কয়েকধাপ এগিয়ে দেয় এই শিল্পকর্মকে। সেই কারণে কমলাকান্তবাবুকে ১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার দিয়েও সম্মানিত করা হয়। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরিরা কেউই আর বেশিদিন এই শিল্প টানতে পারেননি। কমলাকান্তের শিষ্য হিসাবে পরিচিত কার্তিক কর্মকার সের-পাই তৈরি চালিয়ে নিয়ে যান। পরে তাঁর জামাই ভোলানাথ কর্মকার এখন একমাত্র এই সের-পাই তৈরি করছেন। তাঁর দাবি, তাঁর নকশা করা সের-পাই এখনও পর্যন্ত কেউই বানাতে পারেননি। সেই কারণে তাঁর ডাক আসে বিভিন্ন জায়গা থেকে। বর্তমানে ৩০ জনকে বাড়িতে সের-পাই তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি। কীভাবে কাঠ কাঠতে হবে, পিতলের ডিজাইন বানাতে হবে সবকিছুই নিজের হাতে শেখাচ্ছেন সবাইকে। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর দুই মেয়ে রিয়া ও পিয়া। এই সের-পাই তৈরি প্রসঙ্গে ভোলানাথবাবু বলছিলেন, এটিকে আকড়ে ধরে বহু প্রজন্ম জীবিকা নির্বাহ করে এসেছে। কিন্তু এর প্রয়োগগত ব্যবহার আর নেই। এখন কেবলমাত্র শোপিস হিসাবে বিক্রি হয়। সম্প্রতি বেঙ্গালুরুতে অনেকগুলি সের-পাই তৈরি করে পাঠিয়েছি। বছরে ৮০টির মতো সের-পাইয়ের সেট বানাই। এক সেটের দাম ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা পড়ে। চিন থেকে গত মাসে ডাক পেয়েছিলাম। কিন্তু ভিসার সমস্যার কারণে যেতে পারলাম না। তবে আমার তৈরি কাজ এখনও পর্যন্ত কেউ নকল করতে পারেনি। সভ্যতার রূপান্তরে আধুনিক জীবনে অপ্রয়োজনীয় পাই এখন ঘর সাজানোর জিনিস। আমি চলে যাওয়ার পর এই শিল্পের কী হবে, তা জানি না। এই নিয়ে জেলার ইতিহাস গবেষক মানুষজনের দাবি, লোকপুরকে কেন্দ্র করে একটি সের-পাই তৈরির পাকাপাকি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হোক।
  • Link to this news (বর্তমান)